উটপাখি নই, নচিকেতার মতো প্রশ্ন করতে চাই

আমরা নচিকেতার দেশের লোক। যমকেও প্রশ্ন করতে ভয় পাই না। নিরাপত্তা ও ধর্ষণে দোষীদের শাস্তির বিষয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত না স্বচ্ছ ভাবে সব জানতে না পারছি প্রশ্ন জারি থাকবে। কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য বার বার নঞর্থক প্রশ্ন জরুরি। লিখছেন শর্মিষ্ঠা দাসমুশকিল হল আমরা যে মরুঝড়ে বালিতে মুখগোঁজা উটপাখি নই, আমরা যে সবকিছু চোখ মেলে দেখতে চাই, জানতে চাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:০২
Share:

এখানেই চার অভিযুক্তের মৃত্যু হয়। ছবি: পিটিআই

নির্ভয়া থেকে পশু চিকিৎসক তরুণী। কাঠুয়া থেকে উন্নাও। কলকাতা থেকে বারাসাত। দু’বছর শিশু থেকে আশি বছরের মিশনারির সিস্টার। ফুটপাত থেকে পার্কস্ট্রিট। প্ল্যাটফর্মের শিশু থেকে স্কুটিতে চড়া চিকিৎসক।

Advertisement

আর কত? কত? কত?

২৮ নভেম্বর ওই তরুণীর ধর্ষণ ও ভয়ানক মৃত্যুর ঘটনা জানার পরে আবালবৃদ্ধবনিতা— সবাই সাপের মতো ফনা তুলে ফুঁসছিলাম। সবটুকু বিষ হাতে নিয়ে।

Advertisement

আজ সকালে নিয়মমাফিক টিভি খুললাম। পুলিশের সঙ্গে ‘এনকাউন্টার’-এ ধর্ষণে অভিযুক্ত চার জনের মৃত্যুর খবর সব চ্যানেল জুড়ে। মৃতদেহ পড়ে আছে যেখানে, তার খুব কাছেই ওই তরুণীর দগ্ধদেহ পাওয়া গিয়েছিল। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আখড়াইয়ের দীঘি’র নৃশংস ফাঁসুড়ে ডাকাত কালীচরণ বাগদির নিয়তির মতো ঐশ্বরিক প্রতিবিধান যেন! একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়েছে সবার। এই জঘন্য অপরাধে অভিযুক্তদের জন্য মনের কোনও কোণেই মায়া মমতা নেই আমাদের কারও, এতে যেন বিন্দুমাত্র সন্দেহ না থাকে।

মুশকিল হল আমরা যে মরুঝড়ে বালিতে মুখগোঁজা উটপাখি নই, আমরা যে সবকিছু চোখ মেলে দেখতে চাই, জানতে চাই। এই চার অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির তিনটি ধারা ৩০২ (খুন), ৩৭৫ (ধর্ষণ), ৩৬২ (অপহরণ) ছিল বলে শুনেছি। এর সঙ্গে প্রমাণ লোপাট, অশালীন ব্যবহার, মিথ্যা কথা বলা-সহ আরও অনেকগুলি ধারাও হয়তো যুক্ত ছিল। প্রথম তিনটি ধারাই এক জন অভিযুক্তকে বিপজ্জনক চিহ্নিত করার পক্ষে যথেষ্ট। সেই অভিযুক্তদের যখন অপরাধের পুনর্নিমাণ করাতে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হল তখন পর্যাপ্ত সতর্কতা নেওয়া হয়েছিল কি? তাদের হাতকড়া পরানো ছিল কি? শুধু জনগণ কেন ও সঙ্গী পুলিশকর্মীদেরও তো প্রাণের ভয় ছিল!

আমরা ফার্স্ট ট্র্যাক আদালতে দ্রুত বিচার চাইছিলাম। তেলঙ্গনার মুখ্যমন্ত্রী সে দাবি মেনেও নিয়েছিলেন। কিন্তু খুব দ্রুত সব কিছুর নিষ্পত্তি হয়ে গেল। আর সবাই তুবড়ি জ্বালিয়ে উদ্‌যাপন করতে শুরু করলাম। যাঁরা প্রশ্ন করতে চাইলেন, তাঁদের সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে গালাগালি দিলাম। এত সোজা ভাবে অঙ্কের হিসেব মিলিয়ে দিলে ভবিষ্যতে ভয়াল খাদের কিনারায় গিয়ে আমরা দাঁড়াব।

আমরা দ্রুত তদন্ত চেয়েছিলাম। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছিলাম। এই অপরাধের জন্য যে শাস্তি প্রাপ্য। জনগণ দেখত। ভবিষ্যতে মহিলাদের প্রতি সামান্য অসম্মানজনক কিছু করার আগে যাতে হাজার বার ভাবে, দুর্বৃত্তরা যাতে ভয় পায়। এমনটা চেয়েছিলাম। অথচ অভিযুক্তদের মৃত্যু হল আত্মরক্ষার্থে পুলিশের গুলিতে। সমাধান মৃত্যুতে নয়, ধর্ষণের শাস্তিতে। এই মৃত্যুর ফলে ধর্ষণের শাস্তি অভিযুক্তদের আর ছুঁতে পারল না। আরও অনেক তথ্য আমাদের অধরা থেকে গেল চিরদিনের মতো। আদালতের বাইরেই সব ফয়সলা হলে গেল!

ভারতের সর্বশেষ ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৭ সালে ৩২,৫৫৯টি ধর্ষণ মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। কতগুলির নিষ্পত্তি হয়েছে আমরা জানি না এখনও। এনসিআরবি-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১১, ২০১২, ২০১৩ সালের ধর্ষণের মামলাগুলির চার্জশিট দেওয়া ও দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার যথাক্রমে ৮৩.৪%, ৮৫.১%, ৮৩.৬% এবং ২৭%, ২৪.২ %, ২৬.৪%। এনসিআরবি-র বিশ্লেষণগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। যার মাধ্যমে কোথায় গাফিলতি, কোথায় দীর্ঘসূত্রতা, কোথায় গোঁজামিল— এ সবের একটি চিরকালীন নথি থেকে যায়। এই নথির বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আমরা ইতিহাসের ভুল ধরে ভবিষ্যতের অপেক্ষাকৃত ঠিক পথটির খোঁজ করতে পারি। ‘এনকাউন্টার’-এ মৃত্যুর ফলে বিরলতম অপরাধের শাস্তির পুরো ব্যাপারটাতে পাথরচাপা পড়ে গেল। সেই পথ খোঁজা বাধা পেল।

ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার মহত্ত্ব এখানেই যে, তড়িঘড়ি কিছু করতে গিয়ে এক জন নির্দোষী ব্যক্তিও যেন শাস্তি না পায় সে দিকে সর্বদা নজর রাখা হয়। আবার সেই দোহাই দিয়ে বছরের পর বছর ধর্ষক ছাড়া পেয়ে যাবে— সেটাও ক্রমশ আমাদের অসহনীয় হয়ে উঠছে। উন্নাও কাণ্ডে নির্যাতিতা ও তাঁর পরিবারের উপরে আক্রমণের পরেও তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টি কেন তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখা হল না? কেন সে আজ হাসপাতালে মৃত্যুপ্রহর গুনছে? কাঠুয়ার দোষীদের শাস্তি কবে হবে? এই সব প্রশ্নের পাশাপাশি, এনকাউন্টারে যে চার জন মারা গেল তারাই অপরাধী কি না? এই প্রশ্নও থেকে গেল।

ধর্ষণ মামলা ও বিচার

২০১৬ ২০১৭

কতগুলি ঘটনার তদন্ত হচ্ছে: ৫৫,০৭১ ৪৬,৯৮৪
চার্জশিটের হার: ৮৭.৬ ৮৬.৬
বিচারাধীন মামলার সংখ্যা: ১,৫২,১৬৫ ১,৪৬,২
০১
সাজা হয়েছে: ৪,৭৩৯ ৫,৮২২
সাজার হার: ৩২.২ ২৫.৫

সমাজ এক গভীর অসুখে আক্রান্ত। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রোগের কারণ অনুসন্ধান ও বৈজ্ঞানিক মতে চিকিৎসার আশু প্রয়োজন। বিজ্ঞানের যে কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য বার বার নঞর্থক প্রশ্ন জরুরি, ঐশ্বরিক নিদান নয়। মৌলবাদী ফতোয়া বা নির্দেশ নয়। পুলিশবাহিনী নিজেদের রক্ষার জন্য যে তৎপরতা দেখাল, প্রতিটি মেয়ের সুরক্ষার ক্ষেত্রে ঠিক এমনি তৎপরতা দেখতে চাই। তা পাব তো ?

আমরা কিন্তু কঠোপনিষদের দেশের বাসিন্দা। আমরা নচিকেতা। আমরা যমকেও প্রশ্ন করতে ভয় পাই না। আমাদের নিরাপত্তা ও ধর্ষণে দোষীদের শাস্তির বিষয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা স্বচ্ছ ভাবে সব জানতে না পারছি এই প্রশ্ন করা জারি থাকবে।

দুর্গাপুরের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement