Teachers

বড্ড বকেন, কিন্তু পড়ান ভাল

ক-স্যর চেয়ারে বসে পড়ান। ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন না, আমাদেরও লিখতে ডাকেন না। খ-স্যর বলেন, তোরা সাঁওতাল, তোদের কিছু হবে না।

Advertisement

বীরেন পাল

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২০ ০০:০১
Share:

ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করেন শিক্ষক, কিন্তু শিক্ষকের মূল্যায়ন করবে কে? ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা স্কুলশিক্ষকের মূল্যায়নের ব্যবস্থা অনেক দেশেই আছে। এ দেশে এখনও এই বোধটা জন্মায়নি যে, ছাত্রদের মূল্যায়ন শিক্ষকের জন্য অপমানের নয়, অন্যায় নয়, বরং প্রশংসার ও সম্মানের। শিক্ষক যা পড়াচ্ছেন, তা শিশুদের মনে আগ্রহ তৈরি করছে কি না, শিক্ষক ‘মাস্টারমশাই’ থেকে ‘আমাদের মাস্টারমশাই’ হয়ে উঠতে পারলেন কি না, তা বোঝা চাই। শিশুদের মনের অবস্থা না জানলে শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে ওঠে না। স্কুলে বা সমাজে শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে শিশুদের কথা শুনতেই হবে। শিশুদের মূল্যায়ন করার স্বাধীনতা আছে। তাদের সেই অধিকার দেওয়ার সময় এসেছে।

Advertisement

কিন্তু কেমন করে এই মূল্যায়ন করা যায়? সম্প্রতি তা নিয়ে আলোচনা হল বোলপুরে, প্রতীচী ট্রাস্টের বার্ষিক সভায়। একটি প্রাথমিক স্কুলের প্রধানশিক্ষক জানালেন, তিনি তাঁর স্কুলের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের বলেছিলেন, ‘‘কেউ তোদের বকবে না। শিক্ষকদের সম্পর্কে তোদের যা মনে হয়, তা লিখে এনে তোরা বাক্সে ফেলে দিবি।’’ আমি সেই লেখাগুলি পড়ে দেখেছি, তা থেকে ওদের চোখ দিয়ে ক্লাসকে, শিক্ষককে অন্য ভাবে চেনা যায়। কয়েকটি মন্তব্য এই রকম:

ক-স্যর চেয়ারে বসে পড়ান। ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন না, আমাদেরও লিখতে ডাকেন না। খ-স্যর বলেন, তোরা সাঁওতাল, তোদের কিছু হবে না। মিড-ডে মিল খাওয়ার সময় গ-স্যর রোজ খোঁটা দেন, বলেন তোরা খাওয়ার সময় আসিস। ঘ-স্যর খুব বকেন, কিন্তু ইংরেজিটা ভাল পড়ান।

Advertisement

এ থেকে বোঝা যায়, শিশুরা খুঁটিনাটি লক্ষ করে, অনেক কিছু অনুভব করে, যা হয়তো শিক্ষকের কাছে নেহাত তুচ্ছ। তবে একতরফা প্রশংসা বা নালিশ করে, এমনও নয়। তা বলে ওরা অনেক বিচার করে শিক্ষককে গ্রহণ করে, এমন নয়। ওরা স্নেহের স্পর্শ চায় সবার কাছেই। শিক্ষকদের নজর করা, সতর্ক হওয়ার মতো অনেক কিছু মেলে মূল্যায়নে।

পড়ুয়ারা শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতে চাইলে তার পদ্ধতি কী হওয়া উচিত, তার ফলাফলকেই বা কী ভাবে কাজে লাগানো যায়, তার কোনও রূপরেখা নির্ধারিত নেই। এক শিক্ষক প্রস্তাব করলেন, যে যে বিষয়গুলি সম্পর্কে শিক্ষকদের মূল্যায়ন প্রয়োজন, তার কয়েকটি হল সহমর্মিতা (শিশুর আনন্দ-দুঃখের সঙ্গে শিক্ষক কতটা এক হচ্ছেন), সহযোগিতা (শিশু ব্যর্থ হলে শিক্ষক কতটা সাহায্য করছেন), আচরণ (শিক্ষক অহেতুক রূঢ় বা অকারণে প্রশ্রয় দিচ্ছেন কি না), স্পর্শ (ছাত্রের প্রয়োজনে তার গায়ে স্পর্শ করা কিন্তু তা আপত্তিকর স্পর্শ নয়) পোশাক (নিজের চার পাশে যেমন পোশাক দেখতে অভ্যস্ত তার থেকে আলাদা কি না), ইত্যাদি। একটি সমীক্ষাপত্র প্রস্তুত করা যেতে পারে, যেখানে প্রশ্নের পাশে লেখা সম্ভাব্য উত্তরগুলির কোনও একটিতে টিক দেওয়া যাবে (ক-স্যরের ব্যবহার কেমন? খুব ভাল/ভাল/খারাপ/খুব খারাপ)।

এমন ধরনের সমীক্ষাপত্রের নৈতিক যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ মনে হতে পারে, শিশু যেন শিক্ষকের ‘ক্লায়েন্ট,’ বা গ্রাহক। এক গবেষক প্রশ্ন তুললেন, বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর সন্তুষ্টি বুঝতে যেমন ‘ফর্ম’ ভরতে হয়, সরকারি স্কুলে তেমন হবে কেন? বরং ‘‘ক-স্যরকে কেমন লাগে, ভাল/খারাপ’’ এমন ধরনের প্রশ্ন ক্ষতিকর, কারণ তা মাত্র দু’টি বিকল্প দিয়ে একটি মানুষকে বিচার করতে শেখায় শিশুকে। এমন অতি-সরলীকরণ মোটেই শিশুদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি নয়। যেমন, দুই শিশুকে নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘টু’ দেখে শিশুরা বিচিত্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, জানালেন ওই গবেষক। বেশ কয়েক জন শিক্ষক এমন ‘হ্যাঁ-না’, ‘ভাল-খারাপ’ বিকল্পের চাইতে, শিশুর মতামত লেখার উপর জোর দিলেন। বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দের উপর রচনা লিখতে পারলে, শিক্ষকের উপর রচনা লিখতে পারবে না কেন? ‘‘তা থেকে শিক্ষকের জন্য প্রয়োজনীয় কথাগুলি নিষ্কাশিত করে নিলেই হবে’’, সভায় বললেন এক শিক্ষক।

কেউ কেউ প্রশ্ন তুললেন, শিশুদের মূল্যায়নকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া ঠিক? ‘‘যে দিন প্রার্থনার লাইনে গোলমাল করার জন্য বকেছি, সে দিন যদি মূল্যায়ন হয়, তা হলে খারাপ নম্বরই মিলবে আমার’’, বললেন এক শিক্ষিকা। আর এক জনের বক্তব্য, শিক্ষক নিজেই তাঁর পাঠদানে সাফল্যের মূল্যায়ন করতে পারেন, যদি বছরের গোড়ায় এক বার ছাত্রের শেখার স্তর সমীক্ষা করেন, আবার শেষ দিনে পরীক্ষা করে দেখেন, ক্লাসে কী শিখল।

তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়, শিশুরা পড়বে না তো শিক্ষকের কোপে? সমীক্ষার পাতায় নাম লেখা না থাকলেও, ড্রপ বক্সে ফেললেও, হাতের লেখা চিনতে পারেন শিক্ষক। ‘‘শিক্ষকের ইগো থাকলে প্রতিহিংসা থাকবেই’’, বললেন এক শিক্ষক।

আবার শিশুর কথার মান্যতা দিচ্ছেন স্কুলের শিক্ষকেরা, এমন দৃষ্টান্তও কি নেই? প্রতীচীর এক কর্মকর্তা জানালেন, প্রবল গরমে মুর্শিদাবাদের একটি স্কুলে গিয়ে তাঁরা দেখেন, শিক্ষকেরা জ্যাকেট পরে রয়েছেন। তাঁরা জানালেন, খুদে পড়ুয়ারা তাঁদের বলেছে, ‘‘আমাদের ইউনিফর্ম রয়েছে, তোমাদের নেই কেন?’’ তাই তাঁরাও ‘ইউনিফর্ম’ তৈরি করেছেন নিজেদের। শিক্ষক ও শিশুদের মধ্যে এমন সংযোগস্থাপনই ছাত্রদের দ্বারা মূল্যায়নের উদ্দেশ্য হওয়া দরকার।

রূপনারায়ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়,

পশ্চিম মেদিনীপুর

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement