শিক্ষকদের আত্মশুদ্ধির ভাবনাই অনুরণিত হোক

যাকে কেন্দ্র করে এই ‘শিক্ষক দিবস’, সেই রাধাকৃষ্ণণের জীবন-দর্শনই আমরা অনেকে জানি না। তা হলে এ দিবস পালনের গুরুত্ব অনুপ্রাণিত করবে কী ভাবে? লিখছেন সত্যরঞ্জন বিশ্বাস বিনি তখন মক্ষীরানির মতো বৃষ্টিভেজা পাতায় এসে পড়া উচ্ছ্বল সোনাঝরা রোদ্দুর।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:১০
Share:

প্রতীকী ছবি।

‘যখন ছাত্রীর সঙ্গে শিক্ষকের অশালীন আচরণের/ পোস্টমর্টেম করতে বসে দৈনিক কাগজগুলো/ কিংবা শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌনহেনস্থার অভিযোগে/ জনরোষ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে-/ তখন আপনাকে খুব মনে পড়ে।’— এক জন মহিলা কবি তাঁর কলেজজীবনের মোহময় স্মৃতির আলপনাকে এই ভাবে ধরে রেখেছেন বাস্তবের রোদ্দুরে মুড়ে।

Advertisement

বিনি তখন মক্ষীরানির মতো বৃষ্টিভেজা পাতায় এসে পড়া উচ্ছ্বল সোনাঝরা রোদ্দুর। লাবণ্যস্রোতে উদ্ধৃত তার যৌবনের উতরোল উচ্ছ্বাস কলেজের বহু ছেলের হৃদ্‌স্পন্দন রীতিমতো বাড়িয়ে দিত। আমাদের কলেজে তখন ভূগোলের অধ্যাপক আশিসবাবু এলেন কর্মজীবনের প্রথম সোপানে পা রেখে। তখনও তিনি ত্রিশ পেরোননি। সৌম্যদর্শন। চোখে-মুখে সকালি-রৌদ্রের নান্দনিক সম্ভ্রম। যৌবনের সহজাত লঘু চঞ্চলতাকে তিনি যেন ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন, শিক্ষকতার ব্রতকে সশ্রদ্ধ অঙ্গীকারে প্রত্যয়িত করে। পরতে পরতে প্রতিভা আর দক্ষতার স্ফূরণে অল্প দিনেই ছাত্রছাত্রীদের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি এসে গেলেন স্যর। ভূগোল অনার্সের জনা দশেক তাঁর আরও ঘনিষ্ঠ। বিনিও তাদের মধ্যে এক জন।

প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের ছোট্ট পরিসরে থাকতে থাকতে বিনির হৃদয়ের প্রত্যন্ত গভীরে জেগে ওঠা শ্বাস-প্রশ্বাস ঝুঁকে পড়ল স্যরের দিকে। লাজুক আবছায়ার ঘোমটা সরিয়ে আদুরী নদীর মতো সে এক দিন স্যরের কাছে প্রকাশও করে ফেলল তার স্বপ্নবিলাস। আশিসবাবু বিনির হাতে শরৎচন্দ্রের ‘বিপ্রদাস’ ধরিয়ে দিয়ে বললেন— ‘বইটা পড়ে, আমার সঙ্গে দেখা করো।’ সম্পর্কের বাতাবরণ কেমন হতে পারে ‘বিপ্রদাস’-এ শরৎচন্দ্র তার প্রকৃষ্ট চিত্রায়ন ঘটিয়েছেন।

Advertisement

পর দিন বইটা ফেরত দিতে গিয়ে হীনম্মন্যতার বল্গাহীন রক্তক্ষরণে বিনির দু’চোখ উপচে পড়ল নিঃশব্দ জলধারায়। স্যর মাথায় হাত রেখে ‘প্রিয় ছাত্রী’কে আশীর্বাদ করলেন।

মূল্যবোধের গভীরে থাকা অভিজাত অনুভবই সে দিন আশিসবাবুর পেশার প্রতি সম্মানবোধকে জাগিয়ে দিয়েছিল।

আমার কলেজের সহপাঠিনী বিনি এখন এক জন শিক্ষিকা। তাঁর কাছে প্রতি দিনই ‘শিক্ষক দিবস’। কারণ ওই শিক্ষকই তাঁর জীবনপথের দিশা দেখিয়েছিলেন। এখন যখন দেখি, শিক্ষক কর্তৃক কন্যাসমা ছাত্রীদের শ্লীলতাহানির খবর ভাইরাল হচ্ছে, তখন আশিসবাবুর কথা যেমন মনে পড়ে, তেমনই মনে হয় আমাদের মূল্যবোধ কোনও অন্ধকার গুহায় বুঝি এক্কা-দোক্কা খেলছে।

‘শিক্ষক দিবস’এ সে কি ফিরে আসবে? না কি প্রতারিত রাতের পাশেই শুয়ে থাকবে আজীবন? তবে এই মানসিকতাযুক্ত শিক্ষকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। হাতে গোনা দু’পাঁচ জন। হয়তো এক শতাংশ। কিন্তু কালির ছিটে তো লাগছে শিক্ষকদের সাদা কাপড়ে। সেই এক শতাংশের আত্মশুদ্ধি ঘটলে শিক্ষক দিবসের আকাশ আরও উদার-প্রসন্ন ঔজ্জ্বল্যে নন্দিত হবে।

মূল্যবোধের কথা তো গেল, দায়িত্ববোধের বৈধব্য যোগের ঘনঘটাও বেশ দৃশ্যমান। কর্মজীবনে যখন প্রবেশ করলাম, তখন বিদ্যালয়ে আমায় নিয়ে ষোলো জন শিক্ষক। ইউনিট বারোটা। তখন সাতটা করে পিরিয়ড হত। প্রতিটি শিক্ষকের প্রতি দিন ছ’টা করে ক্লাস নিতেই হত। আর দু’একজন শিক্ষক-শিক্ষিকা যদি ছুটি নিতেন, তা হলে সাতটাই। বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকা মিলে পঁয়তাল্লিশ জন। ইউনিট বাইশটা। সারা দিনে তিন বা চারটে ক্লাস অর্থাৎ দু’থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় দিতে হয় ক্লাসে। বেশির ভাগ বিদ্যালয়েই এখন পর্যাপ্ত শিক্ষক। সে ক্ষেত্রে একটা ইতিবাচক দিকও আছে। যেহেতু ক্লাসের সংখ্যা কম, তাই শিক্ষকেরা নিজেদেরকে উজাড় করে দিতে পারেন শ্রেণিকক্ষে। দিচ্ছেনও নব্বই শতাংশ শিক্ষক। সরকারও এর পক্ষে। তাই চল্লিশ জন পড়ুয়া পিছু এক জন শিক্ষক নিযুক্তির ভাবনা সরকারের।

কিন্তু অন্তত দশ শতাংশ শিক্ষক আছেন, ক্লাস সম্পর্কে যাঁদের অনীহার পারদ এখনও বেশ ঊর্ধ্বমুখী। স্মার্ট ফোনের মোহমগ্নতা তাঁদের প্রাণ-মনের দু-কূল এমন ভাবে পরিপ্লাবিত করেছে যে, বেশির ভাগ সময় তাঁরা ক্লাসের সময়-সারণি ভুলে যান। পড়ুয়ারা ডাকতে এলে, কর্ণের শোভননন্দন সোহাগী অলঙ্কার খুলে তাঁরা যখন ক্লাসে যান, তখন যথারীতি দশ-পনেরো মিনিট অতিক্রম করে গিয়েছে সেই পিরিয়ডের সময়সীমা। এই সব তথ্য আরও মেদবহুল হয়ে ছাত্র-ছাত্রী মারফত অভিভাবক, সেখান থেকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে আপামর শিক্ষকসমাজকে জনমানসে হেয় প্রতিপন্ন করে।

এই দশ শতাংশের প্রবণতা-পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। না হলে দূষিত বাতাসের কলঙ্কিত ভ্রুকুটি নিরন্তর আছড়ে পড়বে আমাদের গায়ে। তবে ব্যতিক্রমী শিক্ষকের সংখ্যাও এখনও বেশ রয়েছে। তাঁরা নিজেদের নির্দিষ্ট ক্লাসের বাইরেও অতিরিক্ত ক্লাস নেন। স্কুলের অন্য কাজও করেন। সহকর্মীদের দ্বারা তাঁরা মূল্যায়িত হন ঠিকই, কিন্তু তা তাঁদের পশ্চাতে এবং বক্র বা চটুল কিংবা চাটুবাক্যে। আর সেই বাক্যবাণের গতি সেতারের ঝালার সঙ্গে বাজা জাকির হোসেনের তবলা যেন! এই রসসিক্ত বিষয়ের অগ্রভাগে থাকেন ওই দশ শতাংশ শিক্ষক।

কিন্তু ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের বিপ্রতীপ সমালোচনায় বিদ্ধ না করে, সেই নিষ্ঠ শিক্ষককে অনুসরণে নিজেদের প্রণোদিত করলে শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দু’য়েরই বোধ হয় সুস্বাস্থ্যের সমৃদ্ধি ঘটবে।

সমাজমননে শিক্ষকদের গ্রহণযোগ্যতা ও সম্মান প্রাপ্তির পরিসরটা এই সব কারণেই এখন বেশ সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। তবে অন্য কারণও রয়েছে। শিক্ষকেরা অনেক বেশি ছুটি ভোগ করেন বলে একটা ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। শিক্ষকদের মোট ছুটি— সরকার-নির্দিষ্ট ৬৫+৫২ টা রবিবার, সব মিলিয়ে ১১৭ দিন। কিন্তু রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা পান ৫২টা করে শনি ও রবিবার মিলিয়ে ১০৪ দিন। এ ছাড়াও অন্য ছুটি ৩০টা (এ বছরের হিসাবে), সব মিলিয়ে ১৩৪ দিন। এই সঙ্গে রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা ইএল ভোগ করতে পারেন বছরে ৩০টা, যেটা শিক্ষকদের নেই। এই ছুটির বিষয়টি শিক্ষকদের প্রতি সাধারণ মানুষের ঈর্ষার একটি অন্যতম কারণ। ছুটিগুলি শিক্ষকেরা একসঙ্গে পান বলেই এত দীর্ঘ দেখায়।

অন্য দিকে, শিক্ষকেরা ব্রত এবং পেশাদারিত্বকে কোথায় যেন একটু একাকার করে ফেলেছেন। শিক্ষকতা নিঃস্বার্থ ত্যাগের প্রীতভাষে সকালি-রোদ-পড়া শিশিরের মতো উদ্ভাসিত এক মহান ব্রত। পেশাদারিত্ব সেখানে নির্দিষ্ট বৃত্তে সীমায়িত। তাই শিক্ষকতাকে সেই বৃত্ত থেকে বের করে এনে ত্যাগের রোদ্দুরে সেঁকে নেওয়া দরকার। সৌজন্যবোধ ও শালীনতার ক্ষেত্রেও কিছু কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা পেশাগত মূল্যমান বিস্মৃত হয়ে যান। তাই বহু বিদ্যালয়ের স্টাফরুমে তাঁদের অশালীন বচসা, হাতাহাতি, চুলোচুলি ছাত্রছাত্রীরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে আর গণমাধ্যমে তা মুখরোচক খবর হিসেবে পরিবেশিত হয়।

এই বিষয়গুলি নিয়ে এখন বোধহয় ভাবার সময় এসেছে।

শরৎচন্দ্রের ‘পণ্ডিতমশাই’ উপন্যাসের বৃন্দাবন কেশবকে বলেছিলেন— ‘‘আমার পাঠশালায় একটি শর্ত আছে।---- প্রত্যহ বাড়ি যাওয়ার পূর্বে প্রত্যেক ছাত্রই প্রতিজ্ঞা করে, বড় হয়ে তারা অন্ততঃ দু’টি-একটি ছেলেকেও লেখাপড়া শেখাবে।’’ আমরা বোধ হয় সেরকম ছাত্র তৈরি করতে পারছি না।

বিপরীত পক্ষে পড়ুয়াদের আগ্রহও প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। আসলে যাকে কেন্দ্র করে এই ‘শিক্ষক দিবস’, সেই রাধাকৃষ্ণণের জীবন-দর্শনই আমরা অনেকে জানি না। তা হলে এ দিবস পালনের গুরুত্ব আমাদের অনুপ্রাণিত করবে কী ভাবে?

আর সেই আপ্তবাক্যই বা বাস্তবায়িত হবে কীভাবে— ‘যাকে দেখলেই অবলীলায় শ্রদ্ধায় মাথা লোটে/ যাকে দেখলেই মনের মধ্যে স্বপ্নের ফুল ফোটে/ যাকে দেখলেই বোঝা যায় আদর্শ কাকে বলে/ যার প্রেরণায় জীবন-তরী তরতরিয়ে চলে/ তিনিই হলেন পরমগুরু ‘শিক্ষক’ নামে গণ্য/ তার আদর্শে চলতে পারলে জীবন হবে ধন্য।’’

এই অভিধায় অভিষিক্ত হতে গেলে চাই শিক্ষকদের আত্মশুদ্ধি। তা হলেই ছাত্রছাত্রীর কাছে স্কুল জীবনের প্রত্যেকটা দিনই হয়ে উঠবে যথার্থ ‘শিক্ষক দিবস’।

সরিষাডাঙা ড. শ্যামাপ্রসাদ হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement