শিক্ষা আর শিক্ষক— কতটা গাঢ় দু’য়ের সম্পর্ক?

কোথাও মূল্যবোধের অবক্ষয়। হারাচ্ছে সম্মান। কোথাও আবার অভিভাবক সুলভ সম্পর্ক থেকে গিয়েছে আজও। লিখছেন মনিমা মজুমদারআদর্শ শিক্ষক  অর্থাৎ এমন একজন শিক্ষক যাঁর কথা মনে হলে হাত দু’টো নিজের অজান্তেই একত্রিত হয়ে উঠে আসে কপালে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৩:৪৪
Share:

শিক্ষক-শিক্ষার্থী  সম্পর্ক তখন শুধুমাত্র বিদ্যালয়ের গন্ডিতেই আবদ্ধ ছিল না।

শিক্ষক দিবসের প্রাক্কালে খুব প্রাসঙ্গিকভাবে একটা প্রশ্ন উঠে আসে। আদর্শ শিক্ষকের সংজ্ঞাটা কী ক্রমশ প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে?

Advertisement

আদর্শ শিক্ষক অর্থাৎ এমন একজন শিক্ষক যাঁর কথা মনে হলে হাত দু’টো নিজের অজান্তেই একত্রিত হয়ে উঠে আসে কপালে। মনে পড়ে যায় তাঁর নিরলস পাঠদানের কথা। ছাত্রছাত্রীদের প্রতি তিনি সস্নেহ, অথচ প্রয়োজনে কঠোর শাসকের ভূমিকা নিতেও তিনি পিছপা হন না। কারণ তিনি জানেন যে, যে স্নেহ করে শাসন করার অধিকার শুধু তাঁরই থাকে। আমরা যখন একজন শিক্ষক সম্পর্কে ভাবি আমাদের মনের মধ্যে একজন সৌম্যদর্শন, জ্ঞানী ও শাসন-আদরের মিশেলে তৈরি একজন মানুষের অবয়ব ভেসে ওঠে। উত্তরবঙ্গের বহু প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এক সময়ে এমন শিক্ষক অনেক দেখেছে।

তাঁরা শুধু মাত্র শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন পুরোদস্তর অভিভাবকও। এই শিক্ষকদের সান্নিধ্যে পেতে পারলে, তাঁদের কাছ থেকে কিছু শিখতে পারলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ধন্য মনে করত। খুব বেশি দিন নয়, বছর পনেরো কুড়ি আগেও ছবিটা এমনই ছিল। সেই সময় কোনও পড়ুয়া শিক্ষকদের সামনে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যেত না। মাথায় ছাতা থাকলে শিক্ষকের সামনে সেটি গুটিয়ে রাখাই ছিল রীতি। শিক্ষকদের খুব সামান্য নির্দেশ পালন করার মধ্যে দিয়েও শিক্ষার্থীরা ভীষণভাবে আপ্লুত হত। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক তখন শুধুমাত্র বিদ্যালয়ের গন্ডিতেই আবদ্ধ ছিল না। স্কুল চত্বরের বাইরেও শিক্ষক সমাজ নিজেরাই ছিলেন এক একটি প্রতিষ্ঠান। অনেক শিক্ষার্থী-শিক্ষক নিজেদের সম্পর্ককে ব্যক্তিগত স্তর পর্যায়েও উন্নীত করেছিলেন। এমন অনেক উদাহরণও আছে যে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল কোনও ছাত্র দিনের পর দিন শিক্ষকের বাড়িতেই থেকে গিয়েছে। পড়াশোনা থেকে খাওয়াদাওয়া সবই চলত শিক্ষকের বাড়িতেই। পড়ুয়া-শিক্ষক সুসম্পর্কের অনেক উদাহরণ প্রাচীনকালেও ছিল। শিক্ষকদের ছাত্ররা দেবতারূপে পুজো করতেন। মহাভারতের একলব্য এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। গুরুর নির্দেশ মেনে নেওয়াই ছিল শিষ্যের একমাত্র কর্তব্য। বর্তমানে এই অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনে এখন অত্যাধুনিকতার ছোঁয়া খুবই স্পষ্ট। এর পাশাপাশি একটি শিশুর বড় হয়ে ওঠার পরিবেশেরও পরিবর্তন হয়েছে। বদলেছে মানসিকতাও । এসব কিছুরই প্রভাব পড়ছে বিদ্যালয়গুলোর উপরে। আবার প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কেও। শিক্ষক ও পড়ুয়াদের সম্পর্কের সেই রসায়ন এখন আর দেখা যায় না। সম্পর্কে কোথায় যেন চলে এসেছে কৃত্রিমতা। শুনতে অবাক লাগলে এটাই সত্যি যে, এমন উদাহরণও আছে যেখানে ছাত্র শিক্ষকের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা বোধ করে না। মূল্যবোধের ঠিক কতটা অবক্ষয় হলে এইরকম নিম্নরুচির কাজ করা সম্ভব সেটা ভেবে দেখা উচিৎ নয় কী? আবার কথায় কথায় শিক্ষক ঘেরাও তো এখন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Advertisement

একজন শিক্ষকের কাছে শুধু মাত্র শিক্ষার্থীর নয়, সমাজেরও কিছু চাহিদা থাকে। তিনি শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী, জীবনোপযোগী শিক্ষা দেবেন। তাকে জ্ঞানের পথ দেখাবেন, আলোর পথের যাত্রী হিসেবে গঠন করবেন। মানসিক ও শারীরিক দু’ভাবেই পড়ুয়ারা যাতে ভবিষ্যৎ জীবনের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে শিক্ষক হবেন সেই পথের দিশারী। একজন ভাল মানুষ, সুনাগরিক গঠন করবার দায়িত্বও তো শিক্ষকের উপরেই বর্তায়।

কিন্তু বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, শিক্ষক সমাজের একাংশ শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত গুণাবলীর ধারক নন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের অবনতির মূলে এই কারণকে কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। একজন আদর্শ শিক্ষক তাঁর জীবনকে ছাত্রছাত্রী গঠনের কাজে উৎসর্গ করে থাকেন। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীর কাছে তাঁর কিছু প্রত্যাশাও থাকে। শিক্ষার্থীরা তাঁর দেওয়া শিক্ষায় প্রকৃত অর্থেই শিক্ষিত হবে এটাই একজন শিক্ষকের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা। কিন্তু, এই প্রত্যাশা কী আজ পূরণ হচ্ছে? এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

এই সম্পর্কের অবনতি তো অবশ্যই হয়েছে। উল্টোদিকে, কিছু দৃশ্যে আশার আলোও দেখতে পাওয়া যায়। এখনও এমন দৃশ্য দেখা যায় যে, প্রিয় শিক্ষকের বদলির প্রতিবাদে ছাত্রছাত্রীরা ধর্নায় বসে পড়ে। নিঃসন্দেহে সেই শিক্ষকের সমস্ত কর্মজীবনের সেটাই সেরা প্রাপ্তি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত আছে সমস্ত সমাজ তথা দেশের উন্নয়ন। তাই দু’পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। পরস্পরের কাছ থেকে নির্দিষ্ট প্রত্যাশাগুলি পূরণের চেষ্টা করতে হবে। স্নেহ, ভালবাসা ও সম্মান দিয়ে তৈরি হওয়া সম্পর্কের ভিত কোনওভাবেই যেন নষ্ট না হয়— এটাই কাম্য। এই পবিত্র সম্পর্ককে অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের করা উচিত। তবেই দেশের উন্নতি সম্ভব।

(লেখক বাণেশ্বর জিএসএফ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement