তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
স্বাধীনতা লাভের সতেরো বছর আগে, ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি লাভপুরের মাটিতে তুলে ধরা হয়েছিল দেশের জাতীয় পতাকা। পতাকা তুলেছিলেন লাভপুরের ভূমিপুত্র তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথিতয়শা সাহিত্যিক নন, তিনি তখন স্বাধীনতা-সংগ্রামী এক তরুণ। যাঁর চোখে ব্রিটিশদের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন। সেই লাভপুর আর এখনকার লাভপুরে আকাশপাতাল তফাৎ। লাভপুর তখন নিছকই বীরভূম জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রাম। বড় বিস্ময়ের বিষয়, প্রজাতন্ত্র দিবসের কথা যখন দেশের কল্পলোকেও স্বপ্ন জাগায়নি, সেই সময় গ্রাম্য তরুণ তারাশঙ্কর দেশের তালে তাল মিলিয়ে তিন রঙের জাতীয় পতাকা তুলে ধরেছিলেন তাঁর নিজের গ্রামে—লাভপুরের মাটিতে।
প্রথম যৌবনে লেনিনের আদর্শে অনুপ্রাণিত তারাশঙ্কর মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে গাঁধীপন্থা অনুসরণ করেন। তখন থেকেই লাভপুর অঞ্চলের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে গ্রামোন্নয়নের কাজে নিজেকে দেশের কাজে উৎসর্গ করেন তিনি। তিনিই প্রথম তাঁর এলাকায় কংগ্রেসের সংগঠন গড়ে তোলেন। তাঁর বাড়িতেই শুরু হয় কংগ্রেস পার্টির অফিস। কংগ্রেসকর্মী হিসেবে তাঁর বাড়িতে জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত প্রমুখ নেতাদের যাতায়াত ছিল। তাঁদের নিয়ে তারাশঙ্কর গ্রামে মিটিং করার জায়গা পেতেন না। গ্রামের বাইরে অথবা মুসলমান পাড়ায় কবরস্থানে গিয়ে মিটিং করতেন।
১৯৩০ সালের ২ জানুয়ারি, লাহোর কংগ্রেস কমিটির বৈঠক হল। সেই বৈঠকে কার্যনির্বাহক কমিটিতে জাতির সামনে স্বাধীনতার আদর্শ তুলে ধরার উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—সেবারই অর্থাৎ ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি দেশ জুড়ে ‘পূর্ণ স্বরাজ’ বা ‘স্বাধীনতা দিবস’ উদ্যাপিত হবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারেই ভারতবর্ষের গ্রাম থেকে শহরের প্রতিটি অঞ্চলে বিপুল উৎসাহে ‘স্বাধীনতা দিবস’ পালিত হয়। লাহোরে অনুষ্ঠিত অধিবেশনের দিনই গাঁধী রচিত এবং কংগ্রেস কার্যনির্বাহক কমিটি কর্তৃক গৃহীত একটি শপথবাক্য দেশের সর্বত্র পল্লি ও শহরাঞ্চলে পাঠ করা হল। লক্ষ লক্ষ দেশবাসী দিনটিতে স্বাধীনতার শপথ গ্রহণ করলেন। এই শপথ বাক্যে ঘোষণা করা হয়, “যে কোনও দেশবাসীর মতো ভারতবাসীরও অবিচ্ছেদ্য অধিকার রয়েছে স্বাধীনতা আর যাতে আত্মবিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ মেলে, তার জন্য নিজ শ্রমের ফলভোগের ও জীবনধারণের পক্ষে প্রয়োজনীয় উপকরাণদি পাওয়ার—এই আমাদের বিশ্বাস। আমাদের বিশ্বাস, কোনও সরকার যদি ওই সব অধিকার থেকে কোনও জাতিকে বঞ্চিত করে ও তার উপরে অত্যাচার চালায়, তবে সে জাতির অধিকার আছে ওই সরকার পরিবর্তনের, উচ্ছেদ সাধনের।
ভারতে ব্রিটিশ সরকার দেশের মানুষকে শুধু তাদের স্বাধীনতা থেকেই বঞ্চিত করেনি, সে তার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করেছে জনসাধারণের শোষণের উপরে এবং ভারতের সর্বনাশ করেছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আত্মিক দিক থেকেও। আমাদের তাই বিশ্বাস, ভারতকে ব্রিটিশের সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন এবং পূর্ণ স্বরাজ বা পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতেই হবে।”
স্বাধীনতার এই সঙ্কল্পবাণী রচনা করে কংগ্রেস প্রতিটি প্রাদেশিক ভাষায় তার অনুবাদ করে জেলা, মহকুমা ও থানা-স্তরে পাঠিয়ে দেয়। সংবাদপত্রে নির্দেশ দেওয়া হয়, এই অনুষ্ঠান পালনের। এর অর্থ ইংরেজ রাজত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। ১৯৩০ সালে এর গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি, প্রশাসনিক প্রতিরোধের জল্পনাও ছিল অনেক। বীরভূমে রাজনৈতিক আন্দোলন তখন অনেকখানি পিছিয়ে। রামপুরহাটে জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, সিউড়িতে শরৎচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং গোপিকাবিলাস সেনগুপ্ত, খয়রাশোলের সুরেন সরকার, বোলপুরে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং হংসবাবু, কীর্ণাহারে অম্বরীশ দাস ও তাঁর ভাই দেবনাথ আর লাভপুরে তারাশঙ্কর ও পার্বতীশঙ্কর, দুই ভাই তখন কংগ্রেসের একনিষ্ঠ কর্মী।
বীরভূমের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে থেকেও তরুণ তারাশঙ্কর সমগ্র দেশব্যাপী স্বাধীনতা উৎসব পালনের ইতিহাসে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তাঁর নিজের কথায়: ‘‘ভাবতে ভাবতে আমার বারবার মনে হয়েছে লাভপুরের কথা—১৯৩০ সনের কথাই বলি। মনে হয়েছিল, সব গ্রামে পতাকা উঠবে, স্বাধীনতার সঙ্কল্প পাঠ করা হবে, শুধু আমার লাভপুরেই হবে না? লজ্জায় মাথা হেঁট হবে লাভপুরের?’’ যেমন ভাবা, তেমন কাজ।
১৯৩০ সালে তারাশঙ্কর লাভপুরের ইউনিয়ন বোর্ডের প্রধান কর্মকর্তা। প্রশাসনিক মহলে ভাল পরিচিতি তাঁর। তথাপি প্রশাসনিক মহল তারাশঙ্করকে রাজনীতির কাজ থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। ২৫ তারিখ সকালে তারাশঙ্করের বন্ধু, বোলপুর থানার সার্কেল অফিসার তারাশঙ্করকে ডেকে পাঠান এই বলে, ‘জরুরি দরকার, ২৫শে কীর্ণাহার এসে নানুর (চণ্ডীগড়) ডাক বাংলোতে আমার সঙ্গে দেখা করুন। বিশেষ দরকারি। খুব জরুরি’।
নির্দেশ মতো তারাশঙ্কর কীর্ণাহার গিয়ে অফিসারের সঙ্গে দেখা করেন। অফিসার সেদিন তারাশঙ্করকে বলেছিলেন, ‘আপনি এসব আর করবেন না। একবার ছাত্রজীবনে এই পথে পা দিয়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে হয়েছে। সেই একই ভুল আর করবেন না। দেশের যে গঠনমূলক কাজ করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, তাতে সরকারের তরফ থেকে ভবিষ্যতে আপনি খেতাব, খাতির অনেক কিছু পাবেন। এ বার ইউনিয়ন বোর্ডের শ্রেষ্ঠ কাজের জন্য সরকার আপনাকে পুরস্কৃত করবে। সোনার আংটি দেবে। তা ছাড়া যে পথে চলতে চাইছেন সে পথে হাঁটলে আপনাকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হবে। আপনার অপরাধে আপনার সন্ততি দাগী হবে। তারা আর সরকারি চাকরি পাবে না।’ এমন অনেক কথা বলে সেই পুলিশ অফিসার সে দিন তারাশঙ্করকে ঠেকানোর চেষ্টা করেন। জমিদারেরাও বিরোধিতা করেন।
কিন্তু বাধাকে বাধা মনে করেননি, নিজের সঙ্কল্পে অবিচল তারাশঙ্করের কাছে লাভপুর তখন ‘আমার লাভপুর’। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতবর্ষে প্রথম ‘পূর্ণ স্বরাজ’ বা স্বাধীনতা ঘোষণার দিন লাভপুরের মাথা হেঁট হতে দেননি তারাশঙ্কর। তিনি তাঁর সেবা সমিতির সদস্যদের নিয়ে পতাকা উত্তোলন করেন এবং স্বাধীনতার শপথ বাক্যও পাঠ করেন। কংগ্রেস তখন নতুন নির্দেশ দিয়েছে, ২৬ জানুয়ারি ভোরবেলা উঠে মিছিল বের করে কোনও সাধারণ স্থানে বেদি তৈরি করে সেই বেদির উপরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে হবে এবং গ্রহণ করতে হবে পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্কল্প। কিন্তু, লাভপুরের মাটিতে পতাকা তুলবেন কোথায়?
তারাশঙ্কর লিখেছেন—‘‘১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি জাতীয় পতাকা তুলবার জন্য সাধারণের একটি প্রকাশ্য স্থান খুঁজে পাইনি। জমিদারেরা বাধা দিয়েছে প্রতিটি স্থানে। অবশেষে স্থির করেছি পতাকা তোলা হবে গ্রামের দেবস্থলে, সর্বসাধারণের দেবস্থল, ফুল্লরা মায়ের স্থান সেই ফুল্লরা মায়ের উত্তর দিকে লাভপুর। গণুটিয়া রোডের গায়ে একখানি পতিত জায়গার উপর এই অনুষ্ঠান পালিত হবে।’’
২৬ জানুয়ারি একটি ক্ষুদ্র জনতার সামনে স্বাধীন সঙ্কল্পবাণী পাঠ করে জাতীয় পতাকা তুলেছিলেন তারাশঙ্কর। অনেকের মধ্যে স্মরণীয়, কীর্ণাহার থেকে আগত একটি মানুষ পতাকা-রক্ষী স্বেচ্ছা সৈনিক হয়ে পাশে মাথাখাড়া করে দাঁড়িয়ে প্রণতি জানিয়েছিলেন। শীতকালের সারাটি দিন ও রাত পতাকাটি পাহারা দিয়েছিলেন ওই মানুষটি। পরের দিন পতাকা খুলে তারাশঙ্কর তাঁরই হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন—‘তুমি রাখো’। দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছর ধরে পরাধীন ভারতের সেই স্বাধীন পতাকাটি বুকে ধরে রেখেছিলেন তিনি।
পরে ১৯৬৭ সালের ২৬ জানুয়ারি তারাশঙ্করকে তা ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘১৯৩০ সালে তোলা ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ। আমি সেদিন ভলান্টিয়ার হিসেবে ফ্ল্যাগ পাহারা দিয়েছিলাম। পড়ে গিয়ে আমার হাত কেটে গিয়েছিল। তার রক্ত লেগেছিল এইখানটায়। আপনি আমাকে ফ্ল্যাগটি শিরোপা দিয়েছিলেন। ১৯৩০ সালের জুলাই মাসে আপনি যেদিন কোর্টে সারেন্ডার করতে গেলেন, সেদিনও এই ফ্ল্যাগ নিয়ে আপনাকে নারাণবাবুদের ফুল্লরা বাসে তুলে দিয়ে এসেছিলাম।’’
এ কথা বলে কাগজের মোড়ক খুলে বের করেছিলেন—বিবর্ণ হয়ে যাওয়া তেরঙ্গা পতাকাটি। জাতীয় পতাকা কিন্তু অশোকচক্র লাঞ্ছিত নয়, চরকা আঁকা সেই পতাকা। চমকে উঠেছিলেন তারাশঙ্কর, এ তো সত্যিই সেই ১৯৩০ সালের ২৬শে জানুয়ারির সেই পতাকা! যা তিনি নিজের হাতে তুলেছিলেন। থরথর করে কেঁপে উঠেছিলেন। পতাকাটি দেখে মোচড় দেওয়া বুক চোখের জলে হাল্কা হয়েছিল তারাশঙ্করের।
লেখক সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব