রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ থেকে
‘যে বছর কলিকাতা শহরে প্রথম প্লেগ দেখা দিল তখন প্লেগের চেয়ে তার রাজ-তক্মা-পরা চাপরাসির ভয়ে লোক ব্যস্ত হইয়াছিল।...পাড়ায় প্লেগ দেখা দিল। পাছে হাসপাতালে ধরিয়া লইয়া যায় এজন্য লোকে ডাক্তার ডাকিতে চাহিল না। জগমোহন স্বয়ং প্লেগ-হাসপাতাল দেখিয়া আসিয়া বলিলেন, ব্যামো হইয়াছে বলিয়া তো মানুষ অপরাধ করে নাই।’ -‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে জগমোহনের মৃত্যুর বিবরণ দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ এ ভাবেই প্লেগের ভয়াবহতার কথা শুনিয়েছেন।
১৮৯৮ থেকে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে প্লেগ বিরাট আকার ধারণ করে। কলকাতায় এর প্রভাব মারাত্মক হয়ে ওঠে। মানুষজন দলে দলে ঘর ছাড়তে শুরু করে। সংক্রমণের চেয়েও বেশি ছিল ভয়। আতঙ্কের নানান খবরে কলকাতায় তুমুল শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। ১৮৯৮-এর ৪মে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’য় প্রকাশ পায় এমনই একটি প্রতিবেদন, “আতঙ্কের রূপ অদৃষ্টপূর্ব। আর কখনো কলকাতার বিপুল জনসংখ্যা এইরকম প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়নি। যেসব জেনানার মুখ ‘সূর্যও দেখেনি’, তাঁরাও শহরের পথের উপর দিয়ে দৌড়েছেন, বা ট্রামে-চড়ে পালাতে চেয়েছেন।...গত কয়েকদিনের বিপুলসংখ্যক মানুষের পলায়ন, সেইসঙ্গে দোকানপাট বন্ধ এবং পথে গাড়ি-ঘোড়ার অনুপস্থিতি—সব মিলিয়ে কলকাতা পরিত্যক্ত নগরীর চেহারা ধরেছিল।”
প্লেগের এই ভয়াবহতায় রবীন্দ্রনাথ কেবল সাহিত্য রচনাতেই থেমে থাকেননি, নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। ভগিনী নিবেদিতা তখন সদ্য এসেছেন কলকাতায়। বন্ধুত্ব হয়েছে দু’জনের। মানবহিতৈষী দু’জন সে দিন মহামারি সামলাতে এক সঙ্গে পথে নেমেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ গ্রন্থে লিখেছেন, “সেই সময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এবাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্স্পেক্শনে যেতেন। নার্স ডাক্তার সব রাখা হয়েছিল।”
জগদীশচন্দ্র বসু প্লেগের ভয়ে বাড়ি পরিবর্তন করেছিলেন। তার নির্দিষ্ট কারণ অবশ্য ছিল। ১৩৯ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রিট থেকে তিনি সুহৃদ রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, “উপরের ঠিকানা থেকে বুঝিতে পারিয়াছেন যে, আমি পলাতক—প্লেগের অনুগ্রহে। আমার একজন ভৃত্য ছুটী লইয়া একদিন বড়বাজার গিয়াছিল। সেখান হইতে আসিয়া একদিন পরেই প্লেগ হয়। আর ৩০ ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু। বাড়ি ছাড়িয়া আসিয়া উক্ত ঠিকানায় আছি—কতদিন পলায়ন চলিবে জানি না।” এ কেবল জগদীশচন্দ্র বসুর ক্ষেত্রেই নয়, প্রায় সকল কলকাতাবাসীর এমন অবস্থা দেখা দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথও চিঠি-পত্রাদিতে পরিচিত সকলকে সাবধান করতেন। পাড়ায় পাড়ায় নজরদারিতে যাওয়ার সময়েও প্রত্যেককে ঠিক উপায় অবলম্বনের পরামর্শ দিতেন।
প্লেগ ঠেকাতে ব্রিটিশ সরকার টিকাকরণের পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু তীব্র ইংরেজ-বিদ্বেষ, গুজব, রোগ-ভীতি, পর্দাসীন সাধারণের অন্দরমহলে বাইরের লোকের প্রবেশ ইত্যাদি নানা কারণে সাধারণ মানুষ ক্ষেপে উঠেছিল। এমনকি, রামকৃষ্ণ মিশন থেকে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারপত্র বিলি করা হলে মঠের সন্ন্যাসীদের উপরে আক্রমণও হয়। স্বামী বিবেকানন্দ যে দিন দার্জিলিং থেকে ব্যাগপত্র নিয়ে কলকাতায় আসেন, রাস্তার মানুষ তাঁর প্রতিও মারমুখী হয়ে ওঠে। স্বামীজির ব্যাগে নাকি প্লেগের টিকা আছে। অবশেষে হাত জোড় করে স্বামীজিকে বলতে হয় যে, তিনি ফকির মানুষ, বিদেশ থেকে ফিরছেন।
কলকাতার নাগরিকদের সচেতন করতে রবীন্দ্রনাথও উদ্যোগী হয়েছিলেন। ঠাকুরবাড়ির প্রায় সকল সদস্যই তাতে শামিল হন। ‘Calcutta Notes’ এ নিবেদিতা লিখেছেন, “A few great Hindu families, notably the Tagores, stood firm, in the hope of allaying the agitation.” ঠাকুরবাড়ি যখন প্লেগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, সে সময়েই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নয়-দশ বছরের মেয়ে প্লেগ আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বাধ্য হয়ে তাঁরা চৌরঙ্গির একটা বাড়িতে পালিয়ে যান। সেখানেই তিনি বিখ্যাত ‘শাহজাহানের মৃত্যু’ ছবিটি আঁকেন। অবনীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, “মেয়ের মৃত্যুর যত বেদনা বুকে ছিল সব ঢেলে দিয়ে সেই ছবি আঁকলুম।”
শুধু প্লেগ নয় কলেরা বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো মহামারিতেও রবীন্দ্রনাথ সক্রিয় ভূমিকা নেন। ১৯১৫ সালে বাংলায় কলেরা মারাত্মক আকার নেয়। ঠাকুরবাড়িতেও মৃত্যু হানা দেয়। রবীন্দ্রপুত্র শমীন্দ্রনাথ কলেরায় মারা যায়। কবির লেখনী আরও শক্ত হয়ে ওঠে। ‘ওলাউঠার বিস্তার’ নামক প্রবন্ধে তিনি বিভিন্ন দেশে এ রোগের বিস্তার নিয়ে আলোচনা করেন। ‘গোরা’ উপন্যাসে হরিমোহিনীর স্বামী ও পুত্রের মৃত্যুর কথা লিখতে গিয়ে নিজের দুঃখের কথাই যেন ব্যক্ত করলেন তিনি—“যে দুঃখ কল্পনা করিলেও অসহ্য বোধ হয় তাহাও যে মানুষের সয় ইহাই জানাইবার জন্য ঈশ্বর আমাকে বাঁচাইয়া রাখিলেন।” তাঁর ‘দুর্বুদ্ধি’, ‘দিদি’ ছোটগল্পেও কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কথা আছে।
এর কয়েক বছর পরে যখন ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির আকার নেয়, রবীন্দ্রনাথ আগে থেকেই সতর্ক হয়েছিলেন। এ বারে তিনি একেবারে কবিরাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। শান্তিনিকেতনে এই ফ্লু যাতে না ছড়াতে পারে, তার জন্য তিনি ‘পঞ্চতিক্ত’ পাচন খাইয়েছিলেন প্রত্যেককে। বন্ধু জগদীশচন্দ্রকে (১ জানুয়ারি, ১৯০০) এই পাচনের কথা জানিয়ে তিনি একটি পত্রে লিখেছিলেন, “বৌমার খুব কঠিন রকম ন্যুমোনিয়া হয়েছিল। অনেক দিন লড়াই করে কাল থেকে ভাল বোধ হচ্ছে।...কিন্তু ছেলেদের মধ্যে একটিরও ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়নি। আমার বিশ্বাস, তার কারণ, আমি ওদের বরাবর পঞ্চতিক্ত পাঁচন খাইয়ে আস্চি।...আমার এখানে প্রায় দুশো লোক, অথচ হাসপাতাল প্রায়ই শূন্য পড়ে আছে—এমন কখনও হয় না—তাই মনে ভাবচি এটা নিশ্চয়ই পাঁচনের গুণে হয়েচে।” এই পাচন ছিল নিম, গুলঞ্চ, বাসক, পলতা ও কন্টিকারির মিশ্রণ।
রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় নৈরাশ্য, নিরানন্দ, অনশন ও মহামারি প্রাচীন ভারতের ‘মন্দিরভিত্তি’-কে ভেঙে ফেলছে ক্রমশ। তবে এসব ‘আকস্মিক’ নয়। ‘দেশনায়ক’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “ম্যালেরিয়া-প্লেগ-দুর্ভিক্ষ কেবল উপলক্ষমাত্র, তাহারা বাহ্যলক্ষ্মণমাত্র—মূল ব্যাধি দেশের মজ্জার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে।” কবিগুরুর জন্মদিবস পালনের প্রাক্কালে আমরা যদি এই মূল ব্যাধিকে খুঁজে নিতে পারি, যার কারণে দেশে নিরানন্দ আর মহামারির ছড়াছড়ি এবং তা নিরাময়ের চেষ্টা করি তবেই সমগ্র বিশ্ব সুন্দর হবে।
সহশিক্ষক, সিমলাপাল মদনমোহন উচ্চ বিদ্যালয়, বাঁকুড়া