ছবি: সংগৃহীত।
এক দিকে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, রঘুরাম রাজন, কৌশিক বসু। অন্য দিকে? স্বামীনাথন গুরুমূর্তি। সুকুমার রায়ের জগাইয়ের কথা মনে পড়িতে পারে। সেই তুলনা না-হয় থাকুক। তবে সত্যের খাতিরে বলিতেই হইবে যে, অর্থশাস্ত্রে তাঁহার প্রজ্ঞা সুবিদিত না হইলেও শোনা যায়, সঙ্ঘ পরিবারে এখন তিনিই অর্থনীতির তাত্ত্বিক। শ্রীগুরুমূর্তিকে লইয়া কালক্ষেপ না করিলেও চলিত, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থভাবনায় ভদ্রলোকের প্রভাব গুরুতর বলিয়া জনশ্রুতি। সরকারের ঝুলিতে যথার্থ অর্থনীতিবিদের অভাব প্রকট। প্রথম দফায় তবু জগদীশ ভগবতী ছিলেন— দূর হইতে থাকিলেও, ছিলেন। অরবিন্দ পানাগড়িয়া, অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যমরা ছিলেন। তাঁহাদের তাত্ত্বিক অবস্থানের সহিত কেহ একমত না-ই হইতে পারেন, কিন্তু অর্থশাস্ত্রে তাঁহাদের অধিকার লইয়া প্রশ্ন ছিল না। গুরুমূর্তি সম্বন্ধে সেই কথা বলিবার উপায় নাই। তাহা সত্ত্বেও, কিংবা বোধ করি সেই কারণেই, তিনি অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়দের পরামর্শ, অর্থাৎ গরিব মানুষের হাতে অবিলম্বে নগদ অর্থ তুলিয়া দেওয়ার কথাটিকে ‘হাস্যকর’ বলিয়া উড়াইয়া দিয়াছেন। কাহার যে কিসে হাসি পায়! কিন্তু সমস্যা হইল, নির্মলা সীতারামনরা গুরুমূর্তির হাসিকে অত্যন্ত মূল্যবান জ্ঞান করেন। এত দিন তাঁহারা অর্থশাস্ত্রীদের সুপরামর্শে কর্ণপাত করেন নাই বটে, কিন্তু তাহাকে নস্যাৎও করিয়া দেন নাই। এই বার, গুরুবাক্যের জোরে হয়তো তাঁহারা সেই দাপটও সংগ্রহ করিয়া লইতে পারিবেন। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে অজ্ঞতার জেহাদটি হয়তো এতদ্দ্বারা পরবর্তী স্তরে উত্তীর্ণ হইল।
গুরুমূর্তি— অথবা, তাঁহার মাধ্যমে সঙ্ঘ পরিবার, বা সরকার— প্রশ্ন করিয়াছেন, মানুষের হাতে নগদ অর্থ দেওয়া বা অন্য ভাবে খরচ বাড়াইবার জন্য টাকা আসিবে কোথা হইতে? তিনি ভুলিয়াছেন, টাকা জোগাড়ের উপায় একমাত্র সরকারেরই আছে। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ এফআরবিএম আইন-নির্ধারিত সীমার ঊর্ধ্বে রাখিবার ছাড়পত্র আইনেই আছে। ফলে, সরকার বাজার হইতে ঋণগ্রহণ করিতে পারে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তহবিলেও প্রভূত পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা আছে। তাহার একাংশ বিক্রয়ের মাধ্যমেও টাকার ব্যবস্থা করা সম্ভব। প্রয়োজনে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক নোট ছাপাইয়াও টাকার জোগান বাড়াইতে পারে। এই ব্যয়ের পরিমাণ ‘কুড়ি লক্ষ কোটি টাকা’ হওয়ার প্রয়োজন নাই। রাজনের হিসাব, আপাতত ৬৫,০০০ কোটি টাকা নগদ হস্তান্তর করিলেই চলিবে। অন্যান্য অর্থশাস্ত্রীরাও জানাইয়াছেন, সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ সাকুল্যে জিডিপি-র তিন হইতে পাঁচ শতাংশ বাড়াইলেই বিপদ সামলানো সম্ভব। অর্থাৎ, ছয় লক্ষ কোটি টাকা— অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার এক-তৃতীয়াংশও নহে।
বেশ কিছু সংস্কারমুখী সিদ্ধান্ত ঘোষণার জন্য সরকারের আর্থিক প্যাকেজটি ইতিহাসের পাতায় গুরুত্ব পাইতে পারে, কিন্তু কোভিড-১৯’এর ধাক্কায় ধরাশায়ী অর্থব্যবস্থাকে উদ্ধার করিবার ক্ষেত্রে, অথবা বিপন্ন মানুষের সুরাহা করিবার জন্য নহে। যখন এক দিকে সাধারণ মানুষের আয় অতি অনিশ্চিত, অন্য দিকে বাজারে চাহিদা তলানিতে, তখন সহজলভ্য ঋণের মাধ্যমে অর্থনীতির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা কার্যত অসম্ভব। এই অবস্থায় মানুষের হাতে টাকা জোগাইলে সেই টাকার সিংহভাগ বাজারে ফিরিয়া আসিবে চাহিদার রূপে। অর্থব্যবস্থার চাকা তাহাতেই ঘুরিবে। রঘুরাম রাজনরা এই কথাটিই স্মরণ করাইয়া দিতেছেন। অর্থমন্ত্রীর ঘোষিত ত্রাণ প্যাকেজে এই নূতন রাজস্ব ব্যয়ের পরিমাণ দুই লক্ষ কোটি টাকার সামান্য বেশি— ঘোষিত প্যাকেজের এক-দশমাংশ। এই ধোঁকার টাটি পাছে ধরা পড়িয়া যায়, সেই ভয়েই কি প্রসিদ্ধ অর্থশাস্ত্রীদের বিরুদ্ধে গুরুমূর্তিরা খড়্গহস্ত? না কি, জ্ঞানের প্রতি তাঁহাদের যে স্বাভাবিক বিরাগ, তাহাই ফুটিয়া উঠিতেছে?