আইনটি জরুরি হলেও তার অপব্যবহার নিয়ে অনেক প্রশ্ন
Rhea Chakrabarty

ভয়ের নাম মাদক আইন

শেষ অবধি সাজা হয় বন্দিদের সামান্য অংশেরই। পশ্চিমবঙ্গের জেলে এনডিপিএস-এ অভিযুক্ত ২৫০০, সাজাপ্রাপ্ত ১০২ জন। মাদক কারবার কিন্তু চলছে রমরমিয়ে। কারণ, আসল কারবারিরা থাকে পর্দার আড়ালে।

Advertisement

রঞ্জিত শূর

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২০ ০১:১৭
Share:

অভিযুক্ত: নার্কোটিক্স কন্ট্রোল বুরোর দফতরে হাজিরা দিতে উপস্থিত অভিনেত্রী রিয়া চক্রবর্তী। মুম্বই, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০। ছবি: এএফপি। অভিযুক্ত: নার্কোটিক্স কন্ট্রোল বুরোর দফতরে হাজিরা দিতে উপস্থিত অভিনেত্রী রিয়া চক্রবর্তী। মুম্বই, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০। ছবি: এএফপি।

অভিনেত্রী রিয়া চক্রবর্তী গ্রেফতার হওয়ার পরে এনডিপিএস আইনটি (নার্কোটিক ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্সেস অ্যাক্ট, ১৯৮৫) আলোচনায় উঠে এসেছে। গত প্রায় এক দশক ধরে মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীরা এই আইনটির অপব্যবহার নিয়ে নাগরিক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেও বিশেষ সফল হননি। মধ্যবিত্তের নীতি-পুলিশের মানসিকতা এনডিপিএস আইনে অভিযুক্তকে ‘গাঁজা কেস’ বলে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। পাছে নিজের গায়ে দাগ লাগে! ফলে তলিয়ে দেখেননি বিশিষ্ট মানুষেরা। অভিনেত্রী রিয়া চক্রবর্তী এই আইনে গ্রেফতার হওয়ায় এখন কিছুটা প্রতিফলিত আলো এসে পড়তেও পারে গাঁজা কেস বা ‘পানি কেস’-এ বন্দিদের ভয়াবহ জীবনের উপরেও। রিয়া এখন গাঁজা কেসে অভিযুক্ত ৩৬ হাজার বিচারাধীন জেলবন্দি অভিযুক্তের এক জন।

Advertisement

গাঁজা, চরস, আফিম, কোকেন, কোডেন ইত্যাদি মাদকদ্রব্য নিজের কাছে রাখা, ব্যবহার করা, কেনাবেচা বা কেনাবেচায় সাহায্য, পাচারে যুক্ত থাকা বা সাহায্য করা, এ সবই এই আইনে গুরুতর অপরাধ। আগে এ দেশে প্রকাশ্যে সরকার-স্বীকৃত দোকানে গাঁজা, আফিম ইত্যাদি মাদক দ্রব্য বিক্রি হত। ১৯৮৫ সালে আন্তর্জাতিক চাপে, মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অঙ্গ হিসেবে, এ দেশে সমস্ত ধরনের মাদক নিষিদ্ধ হয়। পাশ হয় এনডিপিএস অ্যাক্ট। অপরাধটি যে সত্যিই গুরুতর, এবং প্রকৃত দোষীদের শাস্তি হওয়া জরুরি, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। প্রশ্ন এই আইনের অপব্যবহার নিয়ে। এই আইন অনুযায়ী, অভিযুক্তের কাছে কতটা পরিমাণে মাদক পাওয়া গিয়েছে, তার উপরে মামলার গুরুত্ব এবং শাস্তি নির্ভর করে। বাণিজ্যিক পরিমাণে পাওয়াটা সব চাইতে দোষের। প্রত্যেক মাদকের আলাদা আলাদা ‘বাণিজ্যিক পরিমাণ’ (গাঁজার ক্ষেত্রে কুড়ি কেজি, আফিমের ক্ষেত্রে আড়াই কেজি) নির্দিষ্ট করা আছে।

বাণিজ্যিক পরিমাণে পাওয়া গেলে অভিযুক্তের জামিন পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সরকারি আইনজীবী জামিনের বিরোধিতা করলে সাধারণত বিচারক জামিন দেন না। কারণ আইনে বলা আছে, সরকারি আইনজীবীর বিরোধিতা উপেক্ষা করে জামিন দিতে হলে বিচারককে নিশ্চিত হতে হবে যে, ওই ব্যক্তি এই অপরাধ করেননি, এবং জামিনে বেরিয়ে তিনি আর কোনও অপরাধ করবেন না। এই শর্তের ফলে বিচারকরা জামিন দিতে দ্বিধা করেন। একাধিক হাইকোর্টের বিচারপতিরা জামিনের এই শর্ত নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, এটা সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় বিধৃত জীবন ও স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারের ধারণার পরিপন্থী।

Advertisement

বস্তুত, সন্ত্রাস নিবারণের আইন (ইউএপিএ) বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইনের চাইতেও ভয়ঙ্কর মাদকবিরোধী আইন। সন্ত্রাস বা রাষ্ট্রবিরোধিতার ধারা প্রয়োগ করতে হলে একটা স্তরে স্বরাষ্ট্রসচিবের অনুমোদন লাগে। ফলে একটা চাপ থাকে পুলিশের উপর। যথেচ্ছাচার করতে পারে না। কিন্তু এনডিপিএস আইনে অভিযুক্তকে জেলে পুরতে পুলিশের কোনও অনুমোদন লাগে না। পুলিশের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ, বল্গাহীন। তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দেওয়ার সীমা সাধারণ অপরাধের ক্ষেত্রে ৯০ দিন, ইউএপিএ মামলায় ১৮০ দিন, এনডিপিএস-এ ৩৬৫ দিন। ইউএপিএ-র মতোই এই আইনেও অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হয় যে, তিিন অপরাধী নন। বাণিজ্যিক পরিমাণে মাদক পাওয়া গেলে ২০ বছরের সাজা হতে পারে। সঙ্গে মোটা টাকা জরিমানা। বিশেষ ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে।

অভিযোগ, মাদকবিরোধী আইনটির জোরে পুলিশ গ্রামাঞ্চলে, বিশেষত বিশেষ কিছু কিছু এলাকায়, যে ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে, তা শহরের মানুষের নজরের বাইরেই থেকে গিয়েছে। গত বছর এ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার রানিনগর, ডোমকল এবং জলঙ্গি থানা এলাকায় তদন্ত করেছিল একটি মানবাধিকার সংগঠন। এই ছোট এলাকার মধ্যে এক হাজারের বেশি ‘পানি কেস’-এ অভিযুক্ত মানুষের সন্ধান মিলেছিল। সেই তদন্ত রিপোর্ট লিখছে, “বহু টাকা খরচ করে কয়েক জন জামিন পেয়েছে। কয়েকশো মানুষ জামিন না পেয়ে জেলে আটক। কেউ কেউ তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে জেলবন্দি। জলের মতো টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে পরিবারগুলোর। অভিযুক্ত গ্রেফতার এড়াতে বাড়িতে আসতে পারছেন না। অনেকে কেরল থেকে বাড়ি ফিরে আসতে পারছেন না।” ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে সারা দেশে এই আইনে গ্রেফতার হয়েছেন ৮১,৭৭৮ জন।

অভিযোগ, এক শ্রেণির পুলিশ, আইনজীবী এবং পেশাদার সাক্ষ্যদাতার লাগাতার টাকা রোজগারের হাতিয়ার এই এনডিপিএস আইন। একই সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতাসীন দলের ভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিবাদী নেতা-কর্মীদের ‘শায়েস্তা’ করারও হাতিয়ার, দাবি করেন বিরোধীরা। এক বার এই আইনে অভিযুক্ত করলে তিন-চার বছর কারাবাস নিশ্চিত। শুধু বলতে হবে, কুড়ি কেজির উপরে গাঁজা বা আড়াই কেজির উপর আফিম পাওয়া গিয়েছে অভিযুক্তের কাছে। অভিযোগকারী পুলিশ আর তদন্তকারী পুলিশ একই ব্যক্তি হলেও মামলা আদালত গ্রাহ্য হবে। অভিযুক্তের পক্ষে যদি সরকারি আইনজীবী বা তদন্তকারী অফিসার বা প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীকে ‘ম্যানেজ’ করা সম্ভব না হয়, তা হলে জামিন অসম্ভব বলেই অভিজ্ঞদের মত।

আর ‘ম্যানেজ’ করতে পারলে? পোড়-খাওয়াদের অভিজ্ঞতা, সে ক্ষেত্রে তদন্তকারী অফিসার ফরেন্সিক পরীক্ষায় পাঠানো মাদকের মধ্যে কিছুটা আসল দিয়ে বাকিটা নকল দিয়ে দেন। ফলে প্রমাণ হয়, ধরা-পড়া মাদকের পুরোটা আসল নয়। ‘প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী’ বিরূপ আচরণ করেন। জামিনে আপত্তি জানান না সরকারি উকিলবাবু। অধিকাংশ জেলায় একটিমাত্র আংশিক সময়ের আদালতে এনডিপিএস মামলার বিচার হয়। তারিখের পর তারিখ পড়তেই থাকে। জেলগুলিতে যে বন্দি-বিদ্রোহ হয়, দেখা গিয়েছে তার মূলে এই এনডিপিএস-বন্দিদের বড় ভূমিকা থাকে। অভিযোগ, তাঁদের অধিকাংশ নিরপরাধ, বা সামান্য অপরাধে অভিযুক্ত তরুণ বন্দি। বছরের-পর-বছর বিচারের প্রহসনের চাপ নিতে পারেন না। চোখের সামনে জামিনের জন্য পরিবারগুলোকে সর্বস্বান্ত হয়ে যেতে দেখেন। ধৈর্য হারিয়ে জেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেই ক্ষোভ উগরে দেন। সবার একই কেস, ফলে দ্রুত ঐক্য তৈরি হয় বন্দিদের মধ্যে।

শেষ অবধি সাজা হয় বন্দিদের সামান্য অংশেরই। পশ্চিমবঙ্গের জেলে এনডিপিএস-এ অভিযুক্ত ২৫০০, সাজাপ্রাপ্ত ১০২ জন। মাদক কারবার কিন্তু চলছে রমরমিয়ে। কারণ, আসল কারবারিরা থাকে পর্দার আড়ালে। উলুখাগড়াদের প্রাণান্ত ঘটে। রিয়া চক্রবর্তীর গ্রেফতার, দীপিকা পাড়ুকোনের জেরা নিয়ে উত্তেজনা থিতিয়ে গেলে হয়তো ফের ধামাচাপা পড়ে যাবে এনডিপিএস আইন নিয়ে চর্চা। পুলিশের গ্রেফতার ক্ষমতার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ, জামিনের শর্ত শিথিল করা, চার্জশিট পেশের সময়সীমা কমানো, এই জরুরি প্রশ্নগুলো চাপা পড়ে যাবে। সব রঙের সরকারই যেহেতু একই ভাবে আইনটিকে ব্যবহার করে, ফলে কেউই তার বিরুদ্ধে সরব হয় না। এই আইনের তাৎপর্য বোঝার দায়, অতএব, নাগরিকের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement