ভারতে সেন্ট্রাল ভিস্টার কথা শুনিয়া হাল্লার রাজার মতো নিরীহ বিস্ময়ে প্রশ্ন করিতে ইচ্ছা করে, ‘‘সমস্যা কি কম পড়িয়াছে?’’ অতিমারিজনিত অর্থসঙ্কটের বৎসরেই কেন কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটিতে হাত দিতে হইল, তাহার সরকারি উত্তরটি কী? সংসদীয় মন্ত্রী উবাচ, বিরোধীরাই তো দুর্দিনে সরকারকে অর্থব্যয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করিয়াছিলেন— সরকার তাহাই করিতেছে। এমন প্রকল্পে বহু লোকের কর্মসংস্থান হইবে। এহেন অকাট্য যুক্তির পরেও অবশ্য নিন্দুকেরা অভিযোগ তুলিয়াছিলেন, এই প্রকল্পে জমির ব্যবহার ও পরিবেশের ছাড়পত্র সংক্রান্ত নিয়মকানুন মানা হয় নাই। মামলা করা হইয়াছিল সুপ্রিম কোর্টেও। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চ সম্প্রতি সবুজ সঙ্কেত দিয়াছে। অর্থাৎ, শিলান্যাস পর্ব পার হইয়া প্রকল্পটি শুরু করিবার পথে কোনও আইনঘটিত বাধা আর রহিল না।
নিঃসন্দেহে প্রকল্পের আইনগত খুঁটিনাটির দিকটি আদালত দেখিবে। তবে কিনা, আদালতের বিচার্য বিষয় ছিল বৈধতা: তাহার বাহিরেও আর একটি প্রশ্ন থাকিয়া যায়, নৈতিকতার প্রশ্ন। অতিমারির ধাক্কায় দেশের অর্থনীতি যখন ধুঁকিতেছে, বৃদ্ধির হার শূন্যের নীচে, কর্মহীনের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে, ঠিক সেই সময়ই নেহাত সৌন্দর্যায়নের জন্য প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প নীতিগত দিক হইতে উচিত কি না, তাহা দেখিবার ভার কি কেন্দ্রীয় সরকারের নহে? এই প্রকল্পকে ঘিরিয়া কর্মসংস্থানের যে অজুহাতটি দেওয়া হইতেছে, তাহা যুক্তির ধোপে টিকিবে না। কর্মসংস্থানের অন্য নানাবিধ উপায় আছে। অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘ দিন ধরিয়া বলিতেছেন যে, অতিমারির কারণে আর্থিক বিপর্যয় রোধে পরিযায়ী শ্রমিক-সহ দরিদ্রদের হাতে নগদ টাকা তুলিয়া দেওয়া প্রয়োজন। সরকার তাহাতে কর্ণপাত করে নাই। বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধার করিতে উৎসাহ দেওয়া হইতেছে। জিএসটি বাবদ রাজ্যগুলির পাওনা অর্থও দেওয়া হয় নাই। সেইখানেও ধারের কাহিনি। আমপান-এর ক্ষতিপূরণ বাবদ নামমাত্র টাকা পৌঁছাইয়াছে পশ্চিমবঙ্গের হাতে। সর্বক্ষেত্রেই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের যুক্তি ছিল, রাজকোষে টাকা নাই। ধার করিয়া তাঁহাকে সংসার চালাইতে হইতেছে। প্রশ্ন উঠে, যে সংসারে ডাল-ভাত জুটিবার নিশ্চয়তা নাই, সেইখানে মহার্ঘ আসবাবে ঘর সাজাইবার বিলাসিতা করা চলে কি? কেহ বলিতে পারেন, বিপন্ন অর্থব্যবস্থাকে উদ্ধার করিতে যত টাকা প্রয়োজন, তাহার তুলনায় সেন্ট্রাল ভিস্টার জন্য ব্যয় অতি সামান্য— অর্থাৎ, এই টাকাটি অতিমারির খাতে খরচ করিলেও পরিস্থিতির ইতরবিশেষ হইত না। কথাটি টাকার অঙ্কে নহে— কথাটি মানসিকতার প্রকাশে। কোন মুহূর্তে কোন কাজটি সরকারের নিকট অগ্রাধিকার পাইতেছে, প্রশ্নটি তাহার। নরেন্দ্র মোদীর সরকার সেই নৈতিকতার পরীক্ষায় ডাহা ফেল করিল।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট প্রায় স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে একটি প্রশ্ন তুলিয়াছে। জরুরি প্রশ্ন। আদালতের কি কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি স্থির করিয়া দিবার ক্ষমতা আছে? ইহা বহু প্রাচীন একটি বিতর্ককে তুলিয়া ধরে— বিচারবিভাগ শাসনবিভাগের কাজ কত দূর নিয়ন্ত্রণ করিতে পারে। শাসক কী নির্মাণ করিবে, কত খরচ করিবে, ইহা সত্যই বিচারবিভাগের বিবেচ্য হইতে পারে না। গণতন্ত্রে প্রত্যেক বিভাগের কাজ নির্দিষ্ট। সুতরাং, কোনও প্রকল্প হাতে লইবার পূর্বে শাসনবিভাগকেই স্থির করিতে হইবে বর্তমান প্রেক্ষিতে সেই কাজ কতটা জরুরি, উন্নয়ন এবং মানবকল্যাণকে স্তব্ধ করিয়া যে কাজ, আদৌ তাহার প্রয়োজন আছে কি না। এবং সেই সিদ্ধান্তের উপরেই স্থির হইবে শাসকের নৈতিকতার দিকটি। এইখানেই বৈধতা এবং নৈতিকতার মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভাজন বর্তমান। সেন্ট্রাল ভিস্টা আইনি বৈধতা অর্জন করিলেও নৈতিকতার ছাড়পত্র পাইল না।