শীর্ষ আদালত। ফাইল চিত্র।
পরকীয়া সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতীয় আইনবিধির ৪৯৭ ধারাটি বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করিতে গিয়া দেশের সর্বোচ্চ আদালত কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলিয়াছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ জানাইয়াছে, দেশের আইনে পরকীয়া বিষয়ক ধারাটি যে কেবল লিঙ্গবৈষম্যের দোষে দুষ্ট তাহাই নহে, ইহার মধ্যে নারী সম্পর্কেও হীন মনোভাব রহিয়া গিয়াছে। কোনও পুরুষের মত না থাকিলে তাঁহার পত্নীর সহিত সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া আইনত দণ্ডনীয়— এমন একটি কথা মানিতে গেলে স্ত্রীকে স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তি ধরিয়া লইতে হয়। স্ত্রী ব্যক্তিটির আলাদা অস্তিত্বই মান্য করা হয় না। শুনিলে প্রথমে অতিসাধারণ মনে হইলেও বক্তব্যটি মোটেই সাধারণ নহে। ভারতের মতো দেশে ঐতিহ্যগত ভাবেই নারীর স্থানটি পুরুষতন্ত্রের বিশালাকার ভারের নীচে পিষ্ট-ক্লিষ্ট। তাহার উপর বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির বৈধতা ও চূড়ান্ততা প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য আইন যদি নারীদেহকে স্বামীর সম্পত্তি ভিন্ন আর কিছুই না মনে করে, তবে দেশের সংবিধানে যে লিঙ্গ-সাম্যের কথা আছে, আইন তাহার সম্পূর্ণ পরিপন্থী হইয়া দাঁড়ায়। আরও একটি প্রশ্ন ওঠে। স্বামীর সম্মতি ভিন্ন কেহ স্ত্রীর সহিত মিলিত হইলে তাহা আইনত দণ্ডনীয়, কথাটি কি এক দিক দিয়া সম্পূর্ণ অর্থহীন নহে? সাধারণত তো এই ধরনের ক্ষেত্রে স্বামীর সম্মতি থাকিবার কথা নয়! অন্য দিক দিয়া ভাবিতে গেলে অবশ্য কথাটি বিষমতর, কেননা স্বামীর সম্মতি থাকিলে যদি কেহ স্ত্রীর সহিত মিলিত হন, তবে তো বিষয়টি বৃহত্তর অপরাধ বলিয়া গণ্য হওয়া উচিত। মূল প্রশ্নটি অবশ্যই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের। স্ত্রীর সহিত অন্য কোনও পুরুষের সম্পর্ক হইবে না কি হইবে না, তাহা নির্ণয় করিবার ক্ষেত্রে স্বামীর স্বীকৃতির কথা উঠিতেছে কেন? উল্টা কথাটা অর্থাৎ স্ত্রীর অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামীর সহিত অন্য নারীর সম্পর্ক হইলে কে অপরাধী গণ্য হইবে, সে কথা তো আইনবিধিতে নাই? কোনও বিবাহে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকেই গুরুত্ব দেওয়া আধুনিক ভদ্র সমাজের দস্তুর। সেই দস্তুর অনুযায়ী, নিজের দেহের উপর পুরুষের মতো নারীরও নিজের সম্পূর্ণ অধিকার থাকে।
গৌরবের কথা, যে সমাজ এত দিন যাবৎ এই পুরুষতান্ত্রিক পরকীয়া আইনটি মানিয়া আসিয়াছে, সেই সমাজের বিচারবিভাগ স্পষ্ট উচ্চারণে নারীদেহের উপর নারীর অধিকারটি মনে করাইয়া দিলেন। খুলিয়া বলিলে, নারীর যৌন সত্তার উপর নারীর অধিকারের কথাটি বলিলেন। পরতে পরতে পুরুষতন্ত্রের চাপে যে সমাজের শ্বাসরোধ হইবার উপক্রম, তেমন সমাজের মুখের উপর এমন কথা বলা সহজ কাজ নয়। বিচারপতি চন্দ্রচূড় প্রশ্ন তুলিয়াছেন, ভারতীয় পরিবারগুলিতে যখন সাধারণ ভাবেই নারী নিগৃহীত নির্যাতিত— সেখানে পরিবারের স্ত্রী যদি অন্য কাহারও কাছে নিজের ক্ষণিক আশ্রয় খুঁজিয়া পান, তাহাতে ক্ষতি কী। এমন সত্য কথাটি যে সমাজের বিচারপতিরা বলিতে পারেন, কী আশ্চর্য পরিহাস যে সেই সমাজের মন এখনও প্রস্তরযুগেই ন্যস্ত— যে যুগের পুরুষ নারীকে শৃঙ্খলিত করিয়া সম্পদ হিসাবে দেখাইত। প্রসঙ্গত, বিচারকরা নারীর যৌন অধিকার স্বীকার করিলেও তাহাকে অকারণ গৌরবান্বিত করেন নাই। বলিয়াছেন— পরিবারের মধ্যে এমন ঘটিলে বিবাহবিচ্ছেদ চাওয়া হইতে পারে, তাহার ভিত্তিতে বিচ্ছেদ স্বীকৃতও হইতে পারে, কিন্তু তাহা হইবে দেওয়ানি বিধির অন্তর্গত, ফৌজদারি বিধিতে ইহার কোনও জায়গা নাই, পরকীয়ার অপরাধের জন্য কাহারও শাস্তি হইতে পারে না। দণ্ডবিধির কোন ধারাটি ফৌজদারি, আর কোনটি নহে— এই প্রশ্ন কিন্তু যে কোনও দেশের আইনব্যবস্থার আদর্শ-ভিত্তির সহিত সরাসরি যুক্ত। এই ধরনের আপত্তিকর আইনবিধি ভারতকে ভারত হইয়া উঠিতে দেয় না, সৌদি আরবের মতো কট্টর পুরুষবাদী দেশের সমগোত্রে ফেলিয়া দেয়।