কুসংস্কার কি দূর হয়েছে পূর্ব বর্ধমান থেকে?

আজও জেলার বেশ কিছু মানুষের মনে কেউ যে ‘ডাইনি’ হতে পারেন, সে সম্পর্কে একটা স্থির বিশ্বাস রয়েছে। জানলে অবাক হতে হয়, যে এই বিশ্বাসকারীদের দলে রয়েছেন বহু শিক্ষিত মানুষও। লিখছেন শ্রীকান্ত বসুধর্মঠাকুরের পুজো সমাজের সর্বস্তরের মধ্যে মিলনের পটভূমি তৈরি করলেও পরবর্তী কালে তার সঙ্গেও জড়িয়ে গেল কুসংস্কার। বলি থেকে শুরু করে বহু বিতর্কিত আচার পালনের মধ্যে দিয়ে বর্তমানে ধর্মঠাকুরের পুজো অনুষ্ঠিত হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:০৫
Share:

কুসংস্কার বিরোধী পথনাটিকা। দুর্গাপুরে। ফাইল ছবি

বাংলার কৃষিভাণ্ডার নামেই জেলার পরিচিতি। এখানকার মানুষ যে চাষবাসে বিশেষ পারদর্শী সে কথা অনেকেই মানেন। সবুজ বিপ্লবের সময় কৃষিকার্যে যখন উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছিল, সেই সময় এ জেলার মানুষই সবার আগে গ্রহণ করেছিলেন চাষের আধুনিক প্রযুক্তিকে। তাই কৃষিজ সম্পদের উৎপাদনে এই জেলা বরাবরই সবার আগে থেকেছে।

Advertisement

স্বাধীনতার পর থেকে একের পরে এক স্কুল ও কলেজ স্থাপিত হয়েছে বর্ধমানে। বেড়েছে শিক্ষার হার। জেলার বহু পড়ুয়াই আজ দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আজও এই জেলায় এমন কয়েকটি ঘটনা ঘটে গিয়েছে বা ঘটে চলেছে যা জেলার জনসচেতনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। গ্রাম-গঞ্জ-শহরের মানুষের মধ্যে আজও রয়ে গিয়েছে বেশ কয়েকটি সংস্কার (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কুসংস্কার) যা সমাজমানসকে যুগের থেকে কিছুটা হলেও পিছিয়ে দিচ্ছে। এই কুসস্কারগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ১) ধর্মীয়, ২) প্রভুত্ব বা ক্ষমতা প্রদর্শনগত এবং ৩) দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতার বিকৃতিগত। পূর্ব বর্ধমানে এই তিন ধরনের কুসংস্কার পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান।

প্রথমে আসা যাক আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত ‘ডাইনি প্রথা’ সম্পর্কিত আলোচনায়। কয়েক বছর আগে এই জেলায় হাটগোবিন্দপুর এলাকায় এক মহিলাকে ডাইনি প্রথার শিকার হতে হয়েছিল। তার পরেও এ দিক সে দিকে ডাইনি অপবাদে মারধর, হেনস্থা করার ঘটনা সংবাদ শিরোনামে এসেছে। তেমন ঘটনার পরে পুলিশ ও প্রশাসনের তরফে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করা হলেও আজও জেলার বেশ কিছু মানুষের মনে কেউ যে ‘ডাইনি’ হতে পারেন, সে সম্পর্কে একটা স্থির বিশ্বাস রয়েছে। জানলে অবাক হতে হয়, যে এই বিশ্বাসকারীদের দলে রয়েছেন বহু শিক্ষিত মানুষও। প্রশাসন তথা সরকারের তরফ থেকে শাস্তি, শিক্ষা, সচেতনতা শিবির— সব কিছুই করা হয়েছে। তবু আজও এর প্রতিকার করা যায়নি। একই ভাবে জেলার নানা প্রান্তে তন্ত্রসাধনার একটি বিকৃত ধারাও প্রচলিত রয়েছে।

Advertisement

অতীতে হিন্দুদের মধ্যে উচ্চ-নীচের দ্বন্দ মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল ধর্মঠাকুরের পুজো। ধর্মঠাকুরের পুজো সমাজের সর্বস্তরের মধ্যে মিলনের পটভূমি তৈরি করলেও পরবর্তী কালে তার সঙ্গেও জড়িয়ে গেল কুসংস্কার। বলি থেকে শুরু করে বহু বিতর্কিত আচার পালনের মধ্যে দিয়ে বর্তমানে ধর্মঠাকুরের পুজো অনুষ্ঠিত হয়। এই সমস্ত আচার-আচরণগুলি কিছু ভক্তের চোখে আত্মশুদ্ধিমূলক বলে ঠেকলেও এর মধ্যে যে পীড়নমূলক দিক রয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। একই রকম আত্মপীড়নমূলক আচরণের আধিক্য দেখা যায় গাজন ও বোলান নাচকে কেন্দ্র করে।

শুধু ধর্ম ঠাকুরের ক্ষেত্রে নয়, বলি-প্রথা জড়িয়ে রয়েছে বহু কালীপুজোকেও। তন্ত্রসাধনার ক্ষেত্রভূমি এই রাঢ়বাংলায় বহু জায়গায় বলি সহকারে পুজো প্রচলিত রয়েছে। অতীতে বহু পুজোয় নরবলির ঘটনাও ঘটত। তবে বর্তমানে নরবলিতে রাশ টানা গেলেও বেশ কিছু জায়গায় কালীপুজো উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ ছাগ বলি দেওয়া হয়। তবে আশার কথা, বর্ধমানে বেশ কিছু পুজো অতীতের এই প্রথা থেকে সরে আসতে শুরু করেছে। বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দিরে বলি-প্রথা তুলে দেওয়া হয়েছে। বলি-প্রথা উঠে গিয়েছে কামালপুর গ্রামের তিনশো বছরের প্রাচীন দুর্গাপুজোতেও।

আবার গ্রামীণ বর্ধমানের অর্থনীতির ভিত্তি চাষাবাদকে কেন্দ্র করেও গড়ে উঠেছে নানা রকমের সংস্কার। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে আজও পূর্ব বর্ধমানের অনেক জায়গায় যে সমস্ত জমিতে পটল চাষ হয়, সেখানে শুদ্ধ বস্ত্রে প্রবেশ করাটাই নিয়ম। তারই সঙ্গে বহু জায়গায় কৃষিকর্মে সংস্কারের বশে মহিলাদের নিযুক্ত করা হয় না। ফলে, উৎপাদন মার খেলেও প্রচলিত সংস্কার থেকে সরে আসার সাহস দেখাতে পারেন না কৃষক। তার সঙ্গে বিবাহ-অনুষ্ঠানে বিধবাদের শামিল হতে না দেওয়া, বেড়াল পেরোলে রাস্তা পার না হওয়ার মতো সংস্কারও রয়েছে।

গ্রামীণ বর্ধমানে আরও একটি কুসংস্কার রয়েছে যা এক শ্রেণির মানুষের জীবিকা অর্জনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে, অথচ, অন্য দিকে তা বহু লোকের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। সেটি হল, বিষধর সাপে ছোবল দিলে চিকিৎসা না করিয়ে ওঝার শরণাপন্ন হওয়ার প্রবণতা। বহু মানুষই সাপে কাটলে প্রথমে ওঝার কাছে যান। তার পরে সেই ওঝা তাঁদের চিকিৎসকের কাছে যেতে বললে, তবেই তাঁরা চিকিৎসকের কাছে বা নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান। এর জেরে অনেকটা সময়টা নষ্ট হয়ে যাওয়ার দরুণ রোগীর প্রাণ সংশয় দেখা দেয়। কিছু ক্ষেত্রে রোগীকে বাঁচানোও যায় না। এই কুসংস্কার দূর করার জন্য প্রশাসনের তরফ থেকে বারবার সচেতনতা-প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু তাতে লাভের লাভ হয়নি কিছুই।

এই সমস্ত কারণে গ্রামীণ মানুষের আয়বৃদ্ধি বা তাঁদের জীবন স্বাচ্ছন্দ্যের বৃদ্ধিকেই একমাত্র ‘ভাল থাকা’র মানদণ্ড ধরলে চলবে না। গুরুত্ব দিতে হবে তাঁদের শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং কুসংস্কারের কারণে মৃত্যুর সংখ্যাকেও। শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেলেও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কুসংস্কার দূর হচ্ছে না। সে সমস্ত ক্ষেত্রে প্রশাসনের কঠোর মনোভাব গ্রহণ করা উচিত। বিজ্ঞান চেতনার বিস্তার এবং প্রকৃত শিক্ষাই পারে মানুষকে প্রকৃত অর্থে কুসংস্কারমুক্ত করে তুলতে।

লেখক বর্ধমান শহরের সাহিত্যকর্মী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement