এস জয়শঙ্কর।
সামনে যে কঠিন দিন আসছে তা জানুয়ারি মাসে ‘রাইসিনা সংলাপে’ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রাক্তন বিদেশসচিব এস জয়শঙ্কর। দেশে ভোটযজ্ঞ শুরু হওয়ার মাস আড়াই আগে ওই সম্মেলনে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘২০১৮ মোটের উপর কেটে গিয়েছে। কিন্তু ২০১৯-এর রাস্তায় অনেক গাড্ডা রয়েছে।’’
বেশ কয়েক বার তাঁর সঙ্গে সফরের সুবাদে এটা জানি যে বংশানুক্রমে পোড়-খাওয়া কৌশলী কূটনীতিবিদ জয়শঙ্কর প্রতিটি বাক্য বলেন, শব্দ ওজন করে করে। বাড়তি তো নয়ই, যেটা অবধারিত ঘটতে চলেছে সেটি বলতে গেলেও কিছুটা কম করে বলেন! যাতে না তার সূত্র ধরে বাড়তি কোনও গুঞ্জনের ক্ষেত্র তৈরি হয়। বিদেশসচিব পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে যখন ‘রাইসিনা সংলাপ’-এ বক্তৃতা দিচ্ছেন জয়শঙ্কর, তখনও এই মিতস্বভাব থেকে সরার কোনও লক্ষণ তাঁর মধ্যে দেখা যায়নি।
আর তাই এহেন জয়শঙ্কর যখন ‘গাড্ডার’ মতো কোনও শব্দ প্রয়োগ করছেন, তখন সাউথ ব্লকের কিছুটা নড়েচড়ে বসা স্বাভাবিক। তাঁর এই মন্তব্যের পর অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে যমুনা দিয়ে। ঘটনাচক্রে বিদেশনীতির ওই স্বনির্দেশিত বন্ধুর পথে প্রধান চালক এখন জয়শঙ্কর নিজেই। মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদীর পুরোদস্তুর কূটনীতিবিদকে পূর্ণ মন্ত্রী করার সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে এ বারের সবচেয়ে বড় চমকও বটে।
মোদীর এই সিদ্ধান্ত যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর প্রথম ইনিংসে বিদেশনীতির ক্ষেত্রে মূলত তিনি মাছের দু’টি চোখ দেখেছিলেন। এক, গোটা বিশ্বে নিজের ব্যক্তিগত পরিচিতি তৈরি করা। দুই, বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতাদের আস্থা অর্জন করে স্মার্ট সিটি, স্বচ্ছ ভারত, গঙ্গা দূষণ মুক্তি, পরিকাঠামো ও নিকাশি ব্যবস্থার উন্নয়নের মতো নিজের স্বপ্নপ্রকল্পগুলিতে আন্তর্জাতিক সহায়তা আদায় করা। সে কাজে তিনি কতটা সফল বা ব্যর্থ, সেই হিসেবনিকেশ নিশ্চয়ই চলতে থাকবে, কিন্তু সে প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর।
ঘটনা এই যে, বিদেশনীতির প্রশ্নে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংস অনেকটাই ভিন্ন। গত পাঁচ বছরে বিশ্বের ভূকৌশলগত হিসেবনিকেশ অনেকটাই বদলে গিয়েছে। ‘‘আমি আর বারাক মাঝে মাঝে হাসি-মশকরা করে থাকি’’, বলার মতো সহজ সরল সুখের দিন নেই আর। জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ না হোক, মোটামুটি নিজের দমে টিকে থাকতে হলেও ভারতের বিদেশনীতিকে তাই এ বার মাপমতো বদলাতে হবে। গত এপ্রিলে অর্থাৎ ভোট শুরু হওয়ার ঠিক আগে অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন-এর (ওআরএফ) একটি অনুষ্ঠানে জয়শঙ্করের বক্তব্যকেই ফের উদ্ধৃত করা যাক। কারণ এর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ভারতের বিদেশনীতির ভবিষ্যৎ রোডম্যাপ। জয়শঙ্করের বক্তব্য, ‘‘আমরা সম্ভবত এমন একটা সময়ে পৌঁছে গিয়েছি, যখন বিশ্বকূটনীতির পুরনো ঘরানাটিই তামাদি হয়ে গিয়েছে। তার মেয়াদ শেষ। চিনের সর্বাত্মক উত্থান, বিদেশনীতি সংক্রান্ত এত দিনকার মার্কিন নীতির খোলনলচে বদলের মতো বিষয়গুলি আমাদের জাতীয় স্বার্থকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে। এবং এ তো সবে শুরু! এই মুহূর্তে যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, আমরা বাধ্য হচ্ছি ঠিকই মানিয়ে নিতে, কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু আমাদের চিন্তায় তার সঙ্গে এখনও খাপ খাইয়ে নিতে পারিনি। বিরোধিতা করে যাচ্ছি মানসিক ভাবে। কূটনৈতিক দৌত্যে ফল পাওয়ার জন্য চেষ্টা এবং আমাদের দায়বদ্ধতা— তার মধ্যে সতত একটা টেনশন বিরাজ করছে।’’
এই দ্বন্দ্বের মধ্যে চলতে চলতে প্রথম দফার শেষে এসে মোদী নির্ঘাৎ এটা বুঝে গিয়েছিলেন যে এমন মন্ত্রীদের বাছাই করা প্রয়োজন যাঁরা আধুনিক বিশ্বব্যবস্থা এবং প্রশাসন যন্ত্রটি সম্পর্কে কিছুটা ওয়াকিবহাল। নিজেদের নীতিকে তাঁরা গড়েপিটে নিতে পারবেন প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে, আমলাদের ‘খপ্পরে’ না পড়ে। জয়শঙ্কর অথবা হরদীপ পুরি (যাঁর গুরুত্বও এ বার বাড়ানো হয়েছে)— এঁদের কাজ শেখাতে হবে না। বরং তাঁরাই প্রখর নজরে রাখবেন তাঁদের মন্ত্রককে।
পাঁচ বছর আগে তখ্তে বসার পর মোদীর প্রথম কাজ ছিল ইউপিএ-টু-র নীতিপঙ্গুতার কারণে কিছুটা ধাক্কা খাওয়া ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে রিফু করা। মজার ব্যাপার হল, ঠিক পাঁচ বছর পর বিদেশমন্ত্রী হিসেবে জয়শঙ্করের প্রথম কাজটিও সেই ভারত-মার্কিন সম্পর্কেরই মেরামতি। এই মুহূর্তে ছিলা টানটান হয়েছে দু’দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক। মার্কিন বাজারে ভারতীয় পণ্য রফতানির প্রশ্নে শুল্ক ছাড়ের সুবিধা ছাঁটাই করে দেওয়ার পর পরিস্থিতি
খুবই উত্তপ্ত। চিনের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্যিক সংঘাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তৈরি হচ্ছে অনিশ্চয়তা— যা ভারত কেন, যে কোনও উন্নয়নশীল দেশের পক্ষেই গভীর উদ্বেগের কারণ। এই দ্বৈরথের মধ্যে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নিজেদের পথ চলতে হবে নয়াদিল্লিকে। একটি দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্কের প্রশ্নে সূক্ষ্ম তারতম্য এবং কাঁটায় মাপা ভারসাম্য রেখে। কখনও মুখের উপর কথা বলার বলিষ্ঠতা দেখানো, আবার কখনও কোনও পক্ষকেই না চটিয়ে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করা।
বিদেশনীতির বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন যে, এ বার ভারতের কৌশলগত ভাবে স্বায়ত্তশাসন বা ‘স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি’র দিন শেষ। নতুন মন্ত্র হল ‘মাল্টি-অ্যালাইনমেন্ট’ বা বহুপাক্ষিক জোট গড়া। দু’টোর মধ্যে বিলক্ষণ তফাত রয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় বা তার আগেও ভারত, অন্তত বাহ্যিক ভাবে, বৃহৎ শক্তিগুলি থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখার নীতি নিয়ে চলেছে। কিন্তু আগামী দিনে ভারতকে কিছুটা নির্দয় ভাবে হলেও কিছু ক্ষেত্রে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেমন, আমেরিকা এবং ইরানের সংঘাতের মধ্যে পক্ষ নেওয়ার ক্ষেত্রে জড়োসড়ো হয়ে থাকলে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি। ওয়াশিংটনকে বোঝাতে হবে যে ইরানকে নিষিদ্ধ করে দেওয়াটা আমেরিকার জাতীয় স্বার্থের মধ্যে পড়ে ঠিকই, কিন্তু মার্কিন স্বার্থকে সম্মান করতে গিয়ে ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করে দেওয়াটা ভারতের কাছে আত্মঘাতের সমার্থক। ইরান থেকে ভারত শুধু অপেক্ষাকৃত সস্তায় তেল ও গ্যাসই আমদানি করে না, সে দেশে ভারতীয় খাদ্যপণ্যের তৈরি বাজার রয়েছে। মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত সংযোগের প্রশ্নে ইরানের গুরুত্ব সংশয়াতীত। ইতিমধ্যেই চাবাহার বন্দর প্রকল্পে বিপুল বিনিয়োগ করে বসে রয়েছে ভারত। ইরানের বাজারে ভারতীয় ওষুধ এবং পরিশোধিত পেট্রোপণ্য রফতানি বৃদ্ধির বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে।
মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর প্রথম প্রকাশ্য বক্তৃতায় জয়শঙ্কর জানিয়েছেন, একা নয়, তাঁর মন্ত্রক বাণিজ্য মন্ত্রকের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করবে। বিদেশে ভারতের পরিকাঠামো এবং বাণিজ্যিক প্রকল্পগুলির সঙ্গে নিয়মিত সম্যক যোগাযোগ রাখা হবে মোদীর ‘প্রগতি’ বৈঠকের মতো। আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে কাজে লাগানো হবে, ভারতের পক্ষে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য।
আর সেটা করার জন্য যে তাঁকে সরু দড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে হবে— মোক্ষম পূর্বাভাসের ঢং-এ সে কথাটা আগেই বোধহয় বলে রেখেছিলেন অধুনা বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর!