চলতি বছরের ৭ থেকে ৩০ জুনের মধ্যে ১৫টি রাজ্যে ৭,২৩৫টি পরিবারের উপরে সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, করোনা আবহে ৬২ শতাংশ পরিবারের শিশুদের পড়াশোনায় ছেদ পড়েছে। এই সমীক্ষা চালিয়েছে শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। লকডাউনের শুরু থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। কবে খুলবে কোনও ঠিক নেই। এই পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাস শুরু করেছে সরকারি ও বেসরকারি— দুই ধরনের স্কুলই। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সরকারি স্কুলের অনেক পড়ুয়াই অনলাইন ক্লাসের সুবিধা নিতে পারছে না।
এর নানা কারণ সামনে এসেছে। যেমন, পশ্চিম বর্ধমানের সরকারি স্কুলের ৭৫ শতাংশ পড়ুয়া প্রথম প্রজন্মের। তাদের পক্ষে অনলাইন প্রযুক্তি ব্যবহার করায় সমস্যা হচ্ছে। অনেকের স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য নেই। কিনলেও, অনলাইন ক্লাস করার জন্য যে পরিমাণ ডেটার প্রয়োজন সেই মূল্যের রিচার্জ করা অনেকের সাধ্যাতীত। প্রথম দিকে শুরু করলেও অনেকেই আর চালাতে পারেননি। এ ছাড়া, রয়েছে নেটওয়ার্কের সমস্যাও।
রাজ্যের শিক্ষা দফতর অনলাইন ক্লাস ও টিভি চ্যানেলেই ভরসা রেখেছে। এখন অবশ্য ফোনেও পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইন ক্লাস করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া, রয়েছে ‘বাংলা শিক্ষা পোর্টাল’। গত ২৭ এপ্রিল নির্দেশ জারি করা হয়েছে। সেখানে কী ভাবে অনলাইনে পড়াতে হবে সে বিষয়ে সবিস্তারে বলে দেওয়া হয়েছিল। মডেল প্রশ্নপত্র দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বহু প্রাথমিক স্কুলে আবার পঞ্চম শ্রেণি চালু হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস হচ্ছে শুধু টিভি চ্যানেলেই হচ্ছিল।
পড়াশোনা কেমন চলছে সে বিষয়ে ২ মে স্কুলগুলিকে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠানোর কথা বলে শিক্ষা দফতর। সেই রিপোর্ট সংগ্রহ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন শিক্ষক-শিক্ষিকরা। তাঁরা জানিয়েছেন, পড়ুয়ারা সবাই ভর্তির সময় যে মোবাইল নম্বর দিয়ে থাকে তা অনেক ক্ষেত্রে বদলে গিয়েছে। অনেকে পড়ুয়ার স্মার্টফোন নেই। অনেকের কেনার ক্ষমতা নেই। লাউদোহা, বিজড়া, সালানপুর, কাঁকসার একাধিক স্কুলে খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ২০০ জন হলে স্মার্টফোন আছে গড়ে ৬০-৭০ জনের বাড়িতে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, ‘‘আমার স্কুলের অনেক অভিভাবক দিনমজুরি করেন। কেউ লোকের বাড়ি কাজ করেন, কেউ ঠিকা শ্রমিক। তাঁদের কী ভাবে স্মার্টক্লাসের কথা বলব?’’
মুদ্রার উল্টো পিঠটাও আছে। অনলাইন ক্লাসের জন্য বহু পড়ুয়ার মোবাইলের প্রতি আসক্তি বাড়ছে। অভিভাবকদের একাংশের অভিযোগ, মোবাইল থেকে ক্লাসওয়ার্ক, হোমওয়ার্ক করার অছিলায় তারা গেম খেলছে, চ্যাট করছে। এখন অনেক পরিবারই ‘নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি’। বাবা, মা-ও অফিস বা বাড়ির কাজে ব্যস্ত। ফলে সঙ্গীর অভাবে বেড়েছে টিভি দেখার সময়। চক্ষুরোগের চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, টানা টিভি বা মোবাইল, কোনওটিই চোখের জন্য ভাল নয়। নির্দিষ্ট রুটিন না থাকায় কথা না শোনা, ধৈর্য্য কমে যাওয়ার মতো নানা আচরণগত সমস্যা দেখা দিয়েছে। যারা একটু বড়, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে, তারাও মানসিক ভাবে অধৈর্য্য হয়ে পড়ছে। মুক্তির উপায় কী? মনোবিদ ইমন পাল বলেন, ‘‘স্কুল বন্ধ। বন্ধ বাইরে বেরোনো। এই অবস্থায় পড়ুয়াদের অবশ্যই নির্দিষ্ট রুটিন মেনে চলতে হবে। কারণ, অর্নিদিষ্টকাল ধরে এমন পরিস্থিতি চলতে পারে। তাই একটু ইন্ডোরগেম খেলা, একটু মেডিটেশন করা দরকার। বাড়ির বাগান বা ছাদে কিছুটা সময় কাটানো যেতে পারে।’’
অন্য দিকে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আশঙ্কা, দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার অভ্যাস নষ্ট হতে পারে। পিছিয়ে পড়া এলাকায় স্কুলছুটের সংখ্যা বাড়তে পারে। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি রিপোর্টেও দেখা যাচ্ছে, ইতিমধ্যেই স্কুলছুটের সংখ্যা বেড়েছে। যে পরিযায়ী শ্রমিকেরা বাড়ি ফিরেছেন, স্কুল বন্ধ থাকায় তাঁদের সন্তানেরা স্কুলে ভর্তি হতে পারেনি। কবে আবার পুরনো কাজের জায়গায় ফিরে যেতে পারবেন, সেটাও অনিশ্চিত। ফলে এই পড়ুয়ারা শিক্ষার অঙ্গন থেকে দূরে থেকে যাবে বলে আশঙ্কা। সব মিলিয়ে শিক্ষামহলের আশঙ্কা, করোনার জেরে হয়তো শিক্ষাক্ষেত্রে বড় সমস্যা নেমে আসতে পারে। এখনই সেই সমস্যা আঁচ করে আগাম পরিকল্পনা ছকে রাখা জরুরি। পরিস্থিতির উন্নতি হলে কী ভাবে তৎপরতার সঙ্গে খামতিগুলিকে পূরণ করা যাবে তা নিশ্চিত করতে হবে। তৈরি করতে হবে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোও।