রাজ্যসভায় পাশ হইল প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস বা পকসো (সংশোধনী) বিল। নূতন বিল অনুসারে, শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনে দোষী সাব্যস্ত হইলে ন্যূনতম কুড়ি বৎসরের কারাদণ্ড, এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। শিশু পর্নোগ্রাফি রুখিবার সংস্থানও বিলে রহিয়াছে। দেশে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা ক্রমশ বিপজ্জনক হারে বাড়িতেছে। কঠোর শাস্তি ব্যতিরেকে সেই প্রবণতা রুখিবার আর কোনও পন্থা নাই। অন্তত, তেমন কোনও পন্থা এখনও অজ্ঞাত। ফলে, আইনটি সংশোধন করিয়া কঠোরতর শাস্তির ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্তটি যথার্থ। কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, পকসো আইন পাশ হইবার পর ছয় সাত বৎসর সময় কাটিয়াছে— তাহা শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা কমাইতে পারিল কোথায়? স্মরণে রাখা বিধেয়, অপরাধ দমনে এই ধরনের আইনের কার্যকারিতা প্রমাণ বা অপ্রমাণ হওয়ার জন্য এই সময়কালটি নিতান্ত অপ্রতুল। ফলে, কঠোরতর শাস্তির মাধ্যমে শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন অপরাধের প্রবণতা দমন করা যাইবে না, এমন দাবি করিবার উপায় নাই। সংশোধনীর মাধ্যমে সময়-নির্দিষ্ট তদন্ত প্রক্রিয়া, আবেদনের দ্রুত বিচার ও নিষ্পত্তি, জামিনের কড়াকড়ি, নূতন ফাস্ট-ট্র্যাক আদালত, বিশেষ বিচার-সহায়ক গবেষণাগারের ন্যায় নীতি গৃহীত হইয়াছে। এমন ঘৃণ্য অপরাধ করিলে তাহার দ্রুত শাস্তি হইবেই, এবং সেই শাস্তি অত্যন্ত কঠোর, সম্ভাব্য অপরাধীদের মনে এই ভীতির সঞ্চার করাই সম্ভবত অপরাধের প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করিবার কুশলীতম পন্থা। শিশুদের উপর যৌন নিপীড়নের সম্ভাবনাকে গোড়ায় বিনষ্ট করা জরুরি।
প্রশ্ন যদি কোথাও থাকে, তবে তাহা মৃত্যুদণ্ডের নৈতিকতা লইয়া। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার দর্শন বলে, অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়াই বিচারের প্রকৃত উদ্দেশ্য। বিরলের মধ্যেও বিরলতম অপরাধের ক্ষেত্রেই মৃত্যুদণ্ড প্রযোজ্য। প্রশ্ন হইল, কোন অপরাধ বিরলের মধ্যেও বিরলতম? তাহা কি সংখ্যার গণনায় নির্ধারণ করা বিধেয়, অর্থাৎ যে অপরাধ খুবই কম ক্ষেত্রে ঘটে, তাহাকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম অপরাধ’ হিসাবে গণ্য করিতে হইবে? না কি, যে অপরাধের ভয়াবহতা বলিয়া দেয় যে খুব বিরল সংখ্যক ক্ষেত্রেই মানুষ এতখানি মনুষ্যত্বহীন হইতে পারে, তাহা ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’? নির্ভয়া কাণ্ডই যেমন। ধর্ষণ একটি নৃশংস, ঘৃণ্য অপরাধ। কিন্তু, নির্ভয়ার ক্ষেত্রে ধর্ষকরা যে মর্মান্তিক শারীরিক অত্যাচার করিয়াছিল, তাহার বীভৎসতা ধর্ষণের ভয়াবহতাকে বহু গুণে ছাপাইয়া গিয়াছিল। এবং তাহাই এই অপরাধটিকে বিরলের মধ্যে বিরলতম করিয়া তুলিয়াছিল। এ-ক্ষণে প্রশ্ন, পকসো-য় প্রাণদণ্ডের যে অবকাশ রহিয়াছে, তাহা কি এই বিচারসাপেক্ষ থাকিবে, না কি বিরলতার বিবেচনাটি ক্রমে গুরুত্বহীন হইয়া উঠিবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, প্রাণদণ্ডের অর্থ অপরাধীর সংশোধনের যাবতীয় সম্ভাবনাকে খারিজ করিয়া দেওয়া। সংশয়াতীত ভাবে ধরিয়া লওয়া যে সংশ্লিষ্ট অপরাধীটি সংশোধনের যোগ্য নহে, সংশোধিত হইবার ক্ষমতা তাহার নাই। শিশুর উপর যৌন নির্যাতনের ন্যায় বর্বর অপরাধ যে করিতে পারে, তাহার ক্ষেত্রেও এই কথাটি পূর্বে সংশয়াতীত ভাবে প্রমাণ করা জরুরি। সুস্থতায় প্রত্যাবর্তনের অধিকার নাকচ করিয়া দেওয়ার পূর্বে সেই সম্ভাবনাটি সম্পূর্ণ বিচার না করা রাষ্ট্রের তরফে মস্ত ভুল হইবে।