ফ্যোল্কার শ্ল্যোন্ডর্ফ
ফ্যোল্কার শ্ল্যোন্ডর্ফ (ছবি)। অশীতিপর তরুণ, জন্ম ১৯৩৯’এ। এ বারের কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে অতিথি হওয়ার সুবাদে আমাদের শহরে এসেছিলেন। গ্যোটে ইনস্টিটিউট, ম্যাক্সমুলার ভবনে বসে এক দিন সকালে কথা বলছিলাম তাঁর সঙ্গে। শ্ল্যোন্ডর্ফ বলছিলেন, যত ছবি করেছেন এ-পর্যন্ত তার অর্ধেকটাই প্রায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সর্বনাশ নিয়ে। গত শতকের প্রথমার্ধের যুদ্ধপরিস্থিতিকে কেন তিনি বেছে নেন বার বার, এমনকি নতুন শতকে এসেও, বিপ্লবের এখন অসময় বলেই কি? না কি সমকাল এমন শূন্য হয়ে আছে যে ফিরে যেতে হচ্ছে ফেলে-আসা কালে? হয়তো দুটোই... ‘‘এমন একটা সময়ে জন্মালাম যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হচ্ছে। ইতিহাস আমার মধ্য দিয়ে, আমার ছবির ভিতর দিয়ে কথা বলে, আমি মাধ্যম মাত্র।’’
জার্মানিতে জন্মালেও ফ্রান্সে চলে যেতে হয়েছিল ছেলেবেলায়। সেখানে বোর্ডিং স্কুলে পড়ার সময় প্রথম মার্ক্সবাদের প্রতি টান তৈরি হয়, তখন আলজিরিয়া-র মুক্তি আন্দোলন শুরু হয়েছে। শুধু ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টিই নয়, গোটা দুনিয়ার কমিউনিস্টরাই তখন আলজিরিয়া-র উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হওয়ার যুদ্ধকে স্বাগত জানিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পাশাপাশি তাঁর এও মনে আছে, কমিউনিস্টদের তখন পশ্চিম জার্মানিতে ভয়ঙ্কর রাক্ষস বা দানবের চেহারায় দেখানো হত, বোঝানো হত— জার্মানি দেশটাকেই দু’টুকরো করে দিয়েছে কমিউনিস্টরা, তার ওপর পূর্ব জার্মানির অধিবাসীদের ক্রমাগত শাসন-পীড়ন করে চলেছে তারা। ফলে কমিউনিস্ট পার্টি একপ্রকার প্রায় নিষিদ্ধই ছিল পশ্চিম জার্মানিতে, কতিপয় যে-ক’জন স্বঘোষিত কমিউনিস্ট তাঁদের তখন জেলে ভরে দেওয়া হচ্ছিল। অথচ শ্ল্যোন্ডর্ফ দেখতে পাচ্ছেন, কমিউনিস্টরাই গরিব আক্রান্ত অসহায় মানুষগুলির দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, ফলে সাধারণ জার্মানদের মনের মধ্যেও কমিউনিস্টদের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন, এমনকি ‘প্রিস্ট’দেরও একটা অংশের। ইতিমধ্যে ষাটের দশকের শেষে সারা ইউরোপ জুড়ে জঙ্গি বামপন্থী ছাত্র-আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছে। এ-সমস্তই তাঁকে মার্ক্সবাদের বাতাবরণে নিয়ে এল, শ্ল্যোন্ডর্ফ খেয়াল করলেন, উপনিবেশের প্রজারা বা শোষিত মানুষজনেরা যে মুক্তি চাইছেন সেই মুক্তির কথাই কমিউনিস্টরা বলছেন।
‘‘খানিকটা আউটসাইডার-এর মতোই ঢুকে পড়েছিলাম সে সময়কার জার্মান জীবনে, সেখানকার মানুষজনের মধ্যে, তাঁদের সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে।’’ সে জন্যেই হয়তো ঈষৎ কৌণিক দূরত্ব থেকে দেখতেন নিজের দেশটাকে। নতুন প্রজন্ম হিসেবে খুঁজে বেড়াতেন নিজেদের অতীত, পূর্বপুরুষ, শিকড়বাকড়। অথচ তখনকার জার্মান সিনেমায় ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে পুরনো সময়টাকে, যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলে কিছু ঘটেইনি। এক বানানো মিথ্যে বাস্তবতা প্রতিনিয়ত সিনেমার বিষয় হয়ে উঠছিল। ‘‘ছবিগুলি হয় সব মিউজ়িক্যাল নয় মেলোড্রামা।’’ বলছিলেন শ্ল্যোন্ডর্ফ, ‘‘যে বাস্তবতায় বেঁচে আছি সে বাস্তবতা তখন ধরা পড়ছে না ছবিতে।’’ যে দেশকে তাঁরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন সে দেশ উঠে আসছে না ছবিতে... ইতিহাসের এই পশ্চাদপসরণ নিয়ে, সমাজটাকে নিয়েই নানা প্রশ্ন তখন শ্ল্যোন্ডর্ফ আর তাঁর সঙ্গী দুই ছবি-করিয়ের মধ্যে— আলেকজান্ডার ক্লুগে আর ওয়ার্নার হার্জগ। তাঁরা তিন জনই তৈরি করেন ‘নিউ জার্মান সিনেমা’।
অনেক দিন পর শ্ল্যোন্ডর্ফ-এর মুখে আবার শুনলাম সেই সব কথা, যা আগে শুনতাম মৃণাল সেনের (প্রায় বছর ঘুরে এল তাঁর প্রয়াণের) মুখে। কথাগুলো অবশ্য গোদার-এর, মজা করে নিজের ছবি সম্পর্কে বলতেন— আমার ছবিতে ‘বিগিনিং, মিডল, এন্ড’ সবই থাকে, তবে ‘নট ইন দ্য সেম অর্ডার’। ফরাসি নতুন ধারার ছবি আসলে প্লট-এর এই নাটকীয় পরম্পরাকেই চ্যালেঞ্জ করেছিল, চ্যালেঞ্জ করেছিল শ্ল্যোন্ডর্ফ-দের নতুন জার্মান সিনেমাও। কারণটা খুব স্পষ্ট করেই বললেন শ্ল্যোন্ডর্ফ: এমন তো আর সত্যি হয় না বাস্তবে, আমাদের জীবন মোটেও ও-রকম বাঁধাধরা তিন অঙ্কে সাজানো নয় যে পর পর সব ঘটে যাবে। অথচ প্রচলিত মূলধারার ছবি ও-ভাবেই গল্প বলে দর্শককে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। রুখতে হলে চার পাশের মতিচ্ছন্ন সময়কে তো কাটাছেঁড়া করতে হবে, সমাজ ও মানুষের গভীর ব্যবচ্ছেদকে তুলে আনতে হবে ছবিতে। বিদ্রোহের সেই অনুষঙ্গ মৃণাল সেনের ছবিতে খুঁজে পান শ্ল্যোন্ডর্ফ, একই ভাবে তাঁর ছবিতেও থাকে বিদ্রোহীরা, ‘‘অধিকাংশ সময়েই তারা হয়তো অসফল হয় শেষ পর্যন্ত, কিন্তু তাতে তাদের লড়াইটা মিথ্যে হয়ে যায় না। বিদ্রোহ আসলে জীবনের একটা চালিকা-শক্তি।’’ শুনতে শুনতে মনে পড়ে গেল... প্রায়ই বলতেন মৃণাল সেন: ‘‘আমাদের ছবিতে পাগলামি আসুক আমি চাই।’’
শ্ল্যোন্ডর্ফ-এর অভিজ্ঞতার নিরিখে আমরাও কি আমাদের বেঁচে-থাকায় কোনও বদলের কথা ভাবতে পারি না? মার্ক্সবাদের ব্যবহারিকতার সবচেয়ে বড় সঙ্কট আজ এই যে, ইতিহাসের জটিল অভিজ্ঞতাকে এড়িয়ে তা শুধু ইতিহাসের গৌরব-অভিজ্ঞতাকে খোঁজে। রুশ বিপ্লবের গরিমাই পরবর্তী কালে সমাজতান্ত্রিক শাসনের অহমিকা হয়ে উঠেছিল, সমাজতান্ত্রিক শাসনের প্রভুত্ব এক দিকে যেমন জনসাধারণকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল, তেমনই সে-শাসনের ক্ষমতার প্রতাপ আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল কমিউনিস্টদেরও, ইতিহাসের প্রকৃত পাঠ তাঁরা বিস্মৃত হয়েছিলেন।
ইতিহাসের এই অসম্পূর্ণতাকে, তার গড়ে-ওঠার গাফিলতিকে যদি প্রখর সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারি আমরা, তবে ইতিহাসের ফিরে-গড়ার অনিবার্যতাকেও স্বাগত জানাতে পারব। যেমন জানাচ্ছে এ-দেশের তরুণ ছাত্রছাত্রীরা, দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমন তরুণ-তরুণীরা। ফের শরণ নিচ্ছেন তাঁরা ‘বামপন্থা’র, বামপন্থাই হয়তো তাঁদের কাছে এ-মুহূর্তে চার পাশের নষ্ট সময়টাকে প্রত্যাখ্যানের ভাষা, প্রতিরোধের একমাত্র পথ। কথায় কথায়
এক বার বললেনও শ্ল্যোন্ডর্ফ, ‘‘ইদার রিফিউসাল অর রিভোল্ট’’। প্রত্যাখ্যানের ভাষার আর এক নামই তো বিদ্রোহ!