সম্পাদকীয় ১

আদালত ও হাদিয়া

হাদিয়ার পরিবার হইতে আপত্তিটি উঠিয়াছে বলিয়াই কি এতখানি দণ্ডচালনা হইল? কেরল হাই কোর্টের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াও প্রশ্ন তোলা চলে, এই রায়ের ফলে লিঙ্গবৈষম্য প্রশ্রয় পাইবে না তো?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ২৩:৩৬
Share:

অখিলা অশোকান নামে যে মেয়ের হিন্দু পরিবারে জন্ম, বয়ঃপ্রাপ্তির পর তিনি যদি স্বেচ্ছায় ধর্ম পরিবর্তন করিয়া পঁচিশ বৎসর বয়সে কোনও মুসলিম যুবককে বিবাহ করেন, সে ক্ষেত্রে তাঁহার সমাজ অসন্তুষ্ট হইলেও হইতে পারে। কিন্তু সমাজের বা আইন-আদালতের কি তাহাতে কিছু বলিবার থাকিতে পারে? যদি এমন জানা যায় যে, তাঁহার স্বেচ্ছা-বিবাহের পাত্রটি কোনও সাধারণ মুসলিম যুবক নহেন, বরং ইসলামি উগ্রপন্থী সংগঠনের সহিত যুক্ত এক জন ভাবী-জঙ্গি, সে ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তিটির বিরুদ্ধে নিশ্চয় তদন্ত চলিতে পারে, তদন্তে আপত্তিজনক কিছু পাওয়া গেলে তাঁহাকে গ্রেফতার পর্যন্ত করা যাইতে পারে। কিন্তু জঙ্গি বলিয়া তাঁহার সহিত তাঁহার স্ত্রীর বিবাহ বানচাল করিয়া দিবার অধিকার কি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের হাতে আছে?— হাদিয়া মামলা প্রকৃতপক্ষেই বুঝাইয়া দিল ভারতীয় সংবিধানমতে যে সব মৌলিক অধিকার ব্যক্তি-নাগরিককে দিবার কথা বলা হয়, কার্যক্ষেত্রে সে সব প্রতিষ্ঠা করিতে ভারতীয় সমাজ তো বটেই, ভারতীয় রাষ্ট্রও ক্ষেত্রবিশেষে কতখানি নারাজ। কেরল হাই কোর্ট কর্তৃক হাদিয়ার সহিত তাঁহার স্বামী শফিন জাহানের বিবাহ অসিদ্ধ করিয়া দিবার সিদ্ধান্ত ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি বিরাট প্রশ্নচিহ্ন হইয়া রহিল। পাশাপাশি, সুপ্রিম কোর্টে যে হঠাৎ করিয়াই সমস্ত জোর গিয়া পড়িল শফিনের ব্যক্তিগত খবরাখবরের উপর— কেরল হাই কোর্টের রায়টির সাংবিধানিক সংগতির উপর নয়— ইহাতে সেই প্রশ্নচিহ্ন আরও দ্বিগুণ দুর্ভাগ্যজনক হইয়া উঠিল। বয়ঃপ্রাপ্ত হাদিয়া-শফিনের প্রথাসিদ্ধ বিবাহ তাঁহাদের দুই জনের মত ছাড়া অসিদ্ধ হইতে পারে না। অন্য কাহারও তাহা অসিদ্ধ করিবার অধিকার থাকিতে পারে না। শফিনের সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থান যাহাই হউক না কেন, এ ক্ষেত্রে তাহা মোটেই প্রাসঙ্গিক নয়। গণতান্ত্রিক দেশে অপরাধীরও বিবাহের অধিকার আছে। মৌলবাদে বিশ্বাসীরও। জঙ্গি সন্ত্রাসীরও। দোষ প্রমাণিত হইলে তাঁহারা শাস্তি পাইতে পারেন, তাঁহাদের বিবাহ ভাঙিয়া দেওয়া চলে না।

Advertisement

প্রশ্ন উঠিবে, হাদিয়ার পরিবার হইতে আপত্তিটি উঠিয়াছে বলিয়াই কি এতখানি দণ্ডচালনা হইল? কেরল হাই কোর্টের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াও প্রশ্ন তোলা চলে, এই রায়ের ফলে লিঙ্গবৈষম্য প্রশ্রয় পাইবে না তো? ভারতীয় সমাজে মেয়ের স্থান তাহার পরিবারে, তাই পরিবারের হেপাজতেই তাঁহাকে রাখা হউক: পঁচিশ বছরের মহিলার পক্ষে এমন সিদ্ধান্ত কি যুক্তিসংগত? হাদিয়ার স্থলে কোনও পুরুষ থাকিলে, এবং তাঁহার ‘বিবাহিতা স্ত্রী’ (তর্কের খাতিরে) জঙ্গি বলিয়া মানিলে কি সেই পুরুষের বিবাহ অসিদ্ধ করিয়া দেওয়া এতই সহজ হইত? প্রশ্নটি সুপ্রিম কোর্টে উঠিয়াছে, মহামান্য বিচারকরা অসন্তুষ্ট হইয়াছেন। কিন্তু তবু প্রশ্নটি থাকিয়া যায়। সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের মুখে ব্যক্তি-পরিসরের দৃঢ় সমর্থন শোনা গিয়াছে। অথচ এখনও ভারতীয় নারীর ব্যক্তি-অধিকার কতটাই অনিশ্চিত!

‘প্রয়োজন’ প্রসঙ্গে আর একটি কথা। হাদিয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনটি বিশেষ রকম এই জন্যই যে এখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের অভিযোগ, তাহারা হিন্দু মহিলাদের ভুলাইয়া বিবাহ করিয়া জঙ্গি সংযোগে যুক্ত করিতেছে। ‘লাভ-জিহাদ’ নামে ইহাকে বর্ণনা করিয়া একটি বিরুদ্ধ আন্দোলন এখন বহুল প্রসার ও প্রচার পাইতেছে ও এই ধরনের মিশ্র বিবাহকে ক্রমশই সন্দেহযোগ্য করিয়া তুলিতেছে। ভিত্তিহীন স্লোগানও যদি লাগাতার উচ্চারিত হয়, তাহা এই ভাবেই জনমানসকে বিষাইয়া দেয়, সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরটিকেও প্রভাবিত করে। ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম-আতঙ্ক নামক অসুখটি যে কত দ্রুত পরিব্যাপ্ত হইতেছে, হাদিয়া কাহিনি তাহা জানাইয়া দেয়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement