ছবি: সংগৃহীত
পৃথিবীর অন্য সব দেশের মতো ভারতের সাধারণ মানুষের মনেও প্রজাতন্ত্র দিবসকে কেন্দ্র করে একটা আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। ছেলেবেলায় আমরা অনেকেই জানতাম না, এই দিনটা আমরা কেন পালন করি? কিন্তু দিনটা ছিল আনন্দের। সকালবেলা এক সঙ্গে স্কুলে গিয়ে জাতীয়সঙ্গীত গাওয়া, মাস্টারমশাইদের দেওয়া ছোট ছোট পতাকা নিয়ে ‘জয় হিন্দ’ বলতে বলতে হাঁটার কথা আজও আমাদের সকলের স্মৃতিতেই কমবেশি অমলিন। সকলে অবশ্য সেই বয়সে দিনটির গুরুত্ব বুঝত না। বাড়ির বড়রা বলতেন, ১৯৪৭ সালে আমাদের স্বাধীনতা লাভের ইতিহাস। পরে বড় হয়ে আমরা জেনেছি ২৬ জানুয়ারির গুরুত্ব। স্বাধীন ভারতের লিখিত সংবিধানই মজবুত করেছিল বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিকদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে গড়ে ওঠা এই দেশের শাসনতন্ত্রের কাঠামোকে। কিন্তু বর্তমান পরিসংখ্যান বলছে, দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের অল্প-শিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষ তো বটেই, বহু স্কুলের উঁচু ক্লাসের পড়ুয়ারাও বলতে পারছে না এই দিনটির গুরুত্ব সম্পর্কে? ফলে গণতন্ত্রের ধারণার বিস্তারে কোথাও কোনও ত্রুটি থেকে যাচ্ছে কি না সে প্রশ্নও উঠছে।
এখনও দেশের প্রায় সব স্কুল-কলেজেই পালিত হয় ১৫ অগস্ট ও ২৬ জানুয়ারি। মনে আছে ছেলেবেলায় যখন মাস্টারমশাইরা ‘বন্দে মাতরম’, ‘জয় হিন্দ’ বলতেন, তখন সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশের ছাত্রদের গোটা শরীর জুড়ে একটা শিহরণ জাগত। আজ ৭০ বছর পরবর্তী প্রজন্মের পড়ুয়ার সঙ্গে বিপ্লবী আন্দোলন ও তার চরিত্রদের পরিচয় মূলত ইতিহাসের বইয়ের সূত্রে। তবে গোটা দেশে ‘চিন্তাশীল’ পড়ুয়াদের একাংশের মনে স্বাধীনতার বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে।
যে মতবাদ অনুসারেই রাষ্ট্রের উৎপত্তির হোক না কেন সব রাষ্ট্র ব্যবস্থারই এক দিকে থাকেন শাসক, অন্য দিকে শাসিত। রাজতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রে এক দিকে, রাজা অন্য দিকে প্রজা। কিন্তু প্রজাতন্ত্র বা গণতন্ত্রে দু’দিকেই রয়েছেন জনগণ। এই ব্যবস্থায় সরকার পক্ষের মানুষজন মূলত দেশের সাধারণ মানুষদের ‘নির্বাচিত প্রতিনিধি’। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসন পরিচালনার মূলে রয়েছে সে দেশের সংবিধান। সংবিধানই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ আইন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধানই শাসক আর শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক সুস্পষ্ট করে দেয়।
সেই উদ্দেশেই আমাদের দেশে ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি তা কার্যকর হয়। সংবিধান অনুসারে, দেশের শাসনক্ষমতার পুরোটাই জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ন্যস্ত। তাঁরা সমাজতান্ত্রিক আদর্শ অনুসরণ করে, সব ধর্মের মানুষের সমানাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। দেশে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, জনস্বার্থে জনগণের হয়ে আইন প্রণয়ন করবেন।
কিন্তু যখনই দেখা যায়, প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্বাচিত সরকারের প্রণীত আইনের সঙ্গে দেশের ভোটদাতাদের স্বার্থের সঙ্ঘাত বাঁধে তখনই সমস্যা সৃষ্টি হয়। যদি দেখা যায় সরকার পক্ষ প্রজাদের দাবিকে উপেক্ষা করে, দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোনও আইন চাপিয়ে দিচ্ছেন তখনই বিঘ্নিত হয় রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো। অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে সংগঠিত একনায়কতন্ত্র বা দলতন্ত্রের উত্থান। ঠিক এ ভাবেই ইতালিতে মুসোলিনি ও জার্মানিতে হিটলারের উত্থান হয়েছিল। প্রথম জীবনে হিটলারও এক জন জনপ্রতিনিধি ছিলেন। ১৯৩২ সালে জার্মান সংসদ নির্বাচনে নাৎসি পার্টি গোটা দেশে একক বৃহত্তম দল হলেও সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেননি। বহুদলীয় সরকার তৈরি হলেও মতভেদের জেরে তার পতন হয়। পুনঃনির্বাচনেও নাৎসিরা একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হন। এই অবস্থায় জার্মান সংসদ একটি বিশেষ আইন (এনাবলিং অ্যাক্ট) পাশ করে। পরে রাষ্ট্রপতি হিন্ডেনবার্গকে প্ররোচিত করে হিটলারকে চ্যান্সেলর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৩৪ সালে হিন্ডেনবার্গের মৃত্যু হলে হিটলার সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিজেকে ‘ফ্যুয়েরার’ ঘোষণা করেন।
ইতিহাস বলে, বহুমতের জটিলতায় কোনও শাসনযন্ত্র যখনই অচল হয়ে পড়ে, তখনই মানুষ আসক্ত হন শাসনক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের দিকে। এই কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয় রাষ্ট্রের সব ধরনের কর্তৃত্ব। আপাত ভাবে কিছু দিন ভাল ভাবে চললেও এই কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে উত্থান হয় ব্যক্তি বা দলতন্ত্রের। রাষ্ট্রগবেষকদের অভিমত, বর্তমানে ভারতেও এই প্রবণতাটি বাড়ছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিযোগ, স্বাধীনতার পর থেকে যে দলই ভারতের শাসনক্ষমতায় বসেছে তাঁদের অনেকের কাছেই দেশের জনসাধারণের কথার থেকে দলীয় কর্মীদের কার্যকলাপ বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাসনক্ষমতা পরিচালনার বহু দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেন শাসক দলের কর্মীরা। এই অবস্থায় ম্রিয়মান হয়ে পড়ে আমলাতন্ত্র। আজও বহু অনুষ্ঠানে দেখা যায়, নির্দেশ দিচ্ছেন শাসক দলের কর্মীরা আর দর্শকাসনে তা দেখছেন আমলারা। গবেষকদের দাবি, ক্ষমতায় বসেই নেতাদের দলীয় সংগঠন আর শাসনতান্ত্রিক পরিকাঠমোকে এক বিন্দুতে এনে ফেলার প্রবণতাই এই অবস্থার জন্য দায়ী। এর জেরেই আমলারা বাধ্য হয়ে শাসকদলের ‘বশংবদ’ হয়ে পড়েন। ভুলে যাওয়া যায়, সরকার সকলের আর দল একটি নির্দিষ্ট আদর্শ বা ব্যক্তিতে বিশ্বাসী সংগঠন।
এই সুযোগে প্রচারে নামেন বিরোধীরা। কঠোরতর হয় রাষ্ট্রশক্তির ফাঁস। ইতিহাস বলে, এমন পরিস্থিতেই প্রণীত হয় একের পর আইন, যাকে বিরোধীরা ‘দমনমূলক’ নামে। এই আইন কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আইনসভায় পাশ হয়ে যায়। চাপা পড়ে শাসকদলের আদর্শ বা তার শীর্ষপদে থাকা ব্যক্তির প্রতি ‘আনুগত্যহীন’ মানুষের কণ্ঠস্বর। এই সুযোগে প্রতিবাদে নামেন বিরোধীরা। বাঁধে সঙ্ঘর্ষ। নষ্ট হয় সরকারি সম্পত্তি। যে সংবিধান গীতা, কোরাণ, বাইবেলকে এক আসনে বসিয়ে সবাইকে সমানাধিকার দিয়েছে তার কার্যকারিতা লঙ্ঘিত হয়।
সংবিধান চালু হওয়ার পরে গুটি গুটি পায়ে সত্তর বছর কেটে গেল। সেই কবে ব্রিটিশরা চলে গিয়েছেন। তার পরে ভারতের তো শুধুই উন্নতির পথে এগনোর কথা ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতা এলেও আর্থিক স্বাধীনতা আজও আসেনি। আর্থিক স্বাধীনতা বলতে সবাই বোঝেন অভাব, অনটন, দৈন্যদশা আর বেকারত্ব থেকে মুক্তি। সকলের জন্য খাদ্য, সকলের জন্য রোজকার। কিন্তু সে স্বাধীনতা আজও মেলেনি।
স্বামী বিবেকানন্দের মতে স্বাধীনতাই উন্নতির প্রথম শর্ত। যেমন মানুষের চিন্তা ও কথা বলার স্বাধীনতা রয়েছে, তেমনই তার আহার, পোশাক, বিবাহ ও অন্য সব বিষয়েই স্বাধীনতার প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, সেই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আমরা কি আদৌ পেয়েছি? নাকি তার থেকে ক্রমশ দূর থেকে দূরতর বিন্দুতে সরে যাচ্ছি।
শিক্ষক ও গবেষক