৩০ জুলাইয়ের ভোর রাত অবধি রুদ্ধশ্বাস আইনি-শুনানির শেষে সকাল সাড়ে ছ’টা নাগাদ যে-ফাঁসি কার্যকর হল, তা নিয়ে পরের হপ্তাখানেক আসমুদ্রহিমাচলের (এবং সারা বিশ্বে, উপমহাদেশের মানুষদের মধ্যে) ফেসবুক-ট্যুইটারসহ সোশ্যাল মিডিয়ায়, হাটেবাজারে, ট্রেনে-বাসে, চায়ের দোকান-কফি হাউসে, খবরের কাগজ-টিভি চ্যানেলে যে মতামত/প্রতর্ক/চর্চার বান ডাকল, তার, মোটের ওপর, দু’টি ভাগ আছে। একটি ভাগ ইয়াকুব মেমনসহ সব রাষ্ট্র-বিরোধীর ‘রক্ত’ চায়, এ-ব্যাপারে ফাঁসি, বা, তার চেয়েও কঠিন কোনও মৃত্যুদণ্ডে বিশ্বাসী। এই মতপন্থীদের কেউ কেউ তো, মেমনের শেষযাত্রায় ‘অনাত্মীয়’ অনুগামীদেরও পুলিশি নজরদারির আওতায় আনতে চেয়েছেন!
অন্য ভাগটির মধ্যে অনেকে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী না হলেও, এই-ফাঁসিটির বিরোধী, কেননা, এতে শাস্তির সমতা লঙ্ঘিত হয়েছে— মুম্বই বিস্ফোরণ-পূর্ববর্তী দাঙ্গাবাজরা পার পেয়ে গেল; গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গার পিছনের ‘মূল মাথা’রা বহাল তবিয়তে থাকল; ১৯৮৪-র দিল্লির শিখ-নিকেশি দাঙ্গার নায়করা এখনও জেলের বাইরে। এই চিন্তাধারায়, এমনটা চলতে থাকলে, সাম্প্রদায়িক বিভাজন বাড়বে। ইয়াকুবের-ফাঁসি-বিরোধীদের বড় অংশই অবশ্য শাস্তি হিসেবে যে কোনও মৃত্যুদণ্ড/ফাঁসির বিরোধী। এঁরা মনে করেন, এই শাস্তি মানবতাবিরোধী, ‘বেঁচে থাকা’র মৌলিক অধিকার তথা মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ, ফলে, প্রকৃতিতে ‘আদিম’; রাষ্ট্রের কল্যাণকামী, জাগতিক সুযোগসুবিধার ‘সুষম’ বণ্টনের ‘ন্যায়পরায়ণ’ ভাবমূর্তির উল্টোপিঠ।
প্রথম মতটি শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের যাথার্থ্য সম্বন্ধে এতটাই নিরেট-নিঃসংশয়, যে সে বিষয়ে আলোচনার খুব একটা অবকাশ নেই। আমার আগ্রহ দ্বিতীয় ভাগটি নিয়েই।
নৃশংস অপরাধীর সংশোধন প্রসঙ্গে দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মীকির বিবর্তনের অতিকথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই বিবর্তনের মধ্যে ‘উত্তরণ’-এর ধারণা নিহিত আছে: ‘অধুনা-অস্তিত্ব’ (‘বিইং’) থেকে ‘হয়ে ওঠা’র (‘বিকামিং’) সম্ভাবনা আছে। আমি তুলনার এই অভিমুখটি একটু ঘুরিয়ে দিতে চাই, শাস্তিপ্রাপক থেকে শাস্তিদাতার দিকে!
কারণ এ ক্ষেত্রেও, ধরে নেওয়া হয় বা আশা করা হয়, একটা বিবর্তন ঘটছে বা ঘটবে: ‘চোখের বদলে চোখ/দাঁতের বদলে দাঁত’-এর আদিম নীতি থেকে রাষ্ট্র হয়ে উঠবে কল্যাণময়, ন্যায়বান, জিঘাংসাহীন ও সকলের অধিকারের সুরক্ষক। অর্থাৎ, দস্যু রত্নাকারের আদিম খোলস ছেড়ে রাষ্ট্র হয়ে উঠবে মনীষী বাল্মীকি! অনেকেই অবশ্য এতটা আশা করেন না, তাঁরা জানেন, রাষ্ট্র একাধারে ‘রত্নাকর’ ও ‘বাল্মীকি’, যার ‘বাঁ হাত’ শঙ্কাহরণ করে, ‘ডান হাতে’ দোলে ভয়াল খড়গ! যে ঘুমপাড়ানি সুরে বলে: ‘আর কেঁদো না, আর কেঁদো না, ছোলা-ভাজা দেব/ এবার যদি কাঁদো তবে তুলে আছাড় দেব’। প্রশ্ন হল, শঙ্কাহরণ থাকা না খড়্গবাহী হওয়া; ছোলা-ভাজা-দেওয়া না তুলে-আছাড়-মারা, কোনটা রাষ্ট্রের প্রকৃত সত্তা? কোনটা না থাকলে রাষ্ট্র ‘রাষ্ট্র’ হবে না?
এখানে মনে রাখার, এই ‘রাষ্ট্র’ তৈরি হয়েছে পশ্চিমে, ‘আধুনিক কাল’-এর সূচনায়, বড় জোর আড়াইশো-তিনশো বছর তার বয়স, বিশ শতকের মধ্যে যে আধুনিক রাষ্ট্র, আর একটি আধুনিক পরিচয়, ‘জাতি’ বা ‘নেশনের’ সঙ্গে মিশে ‘জাতিরাষ্ট্র’ হয়ে উঠে, প্রায় সব দেশে একচেটিয়া ক্ষমতার একমাত্র বৈধ ব্যবস্থা তথা তন্ত্র হয়ে উঠেছে। তাই, প্রাচীন ও মধ্য যুগে, তখনকার রাজ্য বা সাম্রাজ্য, এমনকী পুরনো প্রজাতন্ত্র সমাজের নানা অংশ ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলেমিশে থাকত, ‘আধুনিক’ রাষ্ট্র তেমনটা নয়। নানা সামাজিক প্রকল্প গ্রহণ করলেও সে তার স্বাতন্ত্র্য সুস্পষ্ট রাখে।
এই আধুনিক রাষ্ট্রের কোনটি স্বরূপ— ‘দয়াল’ না ‘ভয়াল’— সে প্রশ্নে গত দু’শতাব্দী ধরে পশ্চিমী জগৎ আলোড়িত হয়েছে। এর মধ্যে, জার্মানির আইনজ্ঞ-রাষ্ট্রদার্শনিক কার্ল শ্মিট-এর (১৮৮৮-১৯৮৫) চিন্তা আধুনিক, যুক্তিসিদ্ধ, বৈধ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের মনোহরণ শরীরের ওপর ফেলেছে তীব্র সন্ধানী আলো। রাষ্ট্রক্ষমতার এই এক্স-রে প্লেটটির উপর একটু নজর বোলানো যাক।
ব্যতিক্রমের একক অধিকার
মানুষ হিসেবে শ্মিট অবশ্য কোনও স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবেন না, কেননা তিনি ছিলেন জার্মানিতে হিটলারের ‘তৃতীয় রাইখ’-এর এক রাজনৈতিক তত্ত্বকার, একনায়কতন্ত্রের ঘোষিত সমর্থক। কিন্তু আইনি-দার্শনিক হিসেবে নাতসি সরকারকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন বলে, তিনি গণতন্ত্র/স্বৈরতন্ত্র নিরপেক্ষ আধুনিক রাষ্ট্রীয় (সার্বভৌম) ক্ষমতাকে নিস্পৃহভাবে কাটাছেঁড়া করে তার ‘স্বরূপ’ প্রকাশ করতে চেয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মিটে গেলে, তাঁর নেতিবাচক রাজনৈতিক দর্শন সত্ত্বেও, বহু তরুণ গবেষককে এ বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা প্রভাবিত করেছে বা ভাবিয়েছে, যাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য হাবেরমাস থেকে দেরিদা, হানা আরেন্ট থেকে স্লাভোস জিজেক, এবং প্রখ্যাত ইতালীয় ভাবুক, জর্জিয়ো আগামবেন।
শ্মিটের বক্তব্য, রাষ্ট্রের ক্ষমতা, তা যতই ‘গণতান্ত্রিক’ ভাবে গঠিত হোক না কেন, যখনই তা কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নীতির ‘ব্যতিক্রম’ ঘটাল (সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত না নিয়ে সিদ্ধান্ত নিল) তখনই তা অনিবার্য ভাবে ‘স্বৈরতন্ত্র’-এর ফাঁদে পা দিল। এটাই আধুনিক রাষ্ট্রের ভবিতব্য। এই যুক্তিকেই আরও প্রসারিত করে তাঁর বক্তব্য, আসলে সাংবিধানিক রীতিনীতি মেনে নয়, তার ‘ব্যতিক্রম’ ঘটিয়েই রাষ্ট্র তার সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে। রাষ্ট্রের এই বিশেষ একক ক্ষমতা প্রযুক্ত করতে আবশ্যক হয় ‘ব্যতিক্রমী অবস্থা’ বা ‘জরুরি অবস্থা’। এই অবস্থায় স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক সংবিধানকে ‘বাতিল’ না করে, কেবল ‘সাসপেন্ড’ করে রেখেই রাষ্ট্র তার বিশেষ অগণতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। যেমন, হিটলারের উত্থানের আগে রচিত জার্মানির ‘হ্বাইমার প্রজাতন্ত্র’-এর সংবিধানকে খারিজ না করেই কেবল চার বছর অন্তর অন্তর সাসপেন্ড করে রেখেই ‘তৃতীয় রাইখ’ তার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চালিয়ে গেছে।
শ্মিটের এই ‘ব্যতিক্রম’-এর (exception) ধারণা ব্যবহার করে আগামবেন পশ্চিমী জগতের উদার গণতন্ত্রগুলির স্বৈরাচারী বা ব্যতিক্রমী রূপটি আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন, বিশেষত পশ্চিমী জগতের শিরোমণি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ানক মুখটি, যে, সারা বিশ্বে গণতন্ত্র সরবরাহ করার মহান ব্রত ঘোষণা করলেও, সন্দেহভাজন তথা সন্ত্রাসবাদীদের উপর বিনা বিচারে উৎকট অত্যাচার চালিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি করেছে ‘গুয়ান্তানামো বে’-র নিপীড়ন শিবির, যা ভৌগোলিক ও আইনি দিক থেকে মার্কিন সীমানার ‘বাইরে’!
তাই, প্রশ্নটা রাষ্ট্রের ব্যতিক্রমী ক্ষমতার। যেমন, ইউরোপের প্রায় সব দেশেই তো মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করা হয়েছে, কিন্তু সেখানেও কি রাষ্ট্রের হাত থেকে সন্দেহভাজন/ অপরাধীদের উপর শারীরিক অত্যাচার, এমনকী ‘বিপদের সম্ভাবনা’র কথা বলে হত্যার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে? সংসদীয় গণতন্ত্রের পীঠস্থান ব্রিটেনের রাজধানীতে পুলিশ, ৭ জুলাই ২০০৫-এর প্রাণঘাতী বিস্ফোরণের পনেরো দিন পর ওই বিস্ফোরণে যুক্ত সন্দেহে, কোনও প্রমাণ ছাড়াই, ২৭ বছরের ব্রাজিলীয় অভিবাসী যুবককে টিউব রেল স্টেশনে বিনা প্ররোচনায় গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছিল। ব্রিটেন ছেড়ে দেশের মধ্যে ঢুকলে দেখব, সংবিধানের মধ্যেই, জরুরি অবস্থা জারি ছাড়াই, ব্যতিক্রম ঘটানোর কত সুযোগ রাষ্ট্রকর্তাদের দেওয়া হয়েছে। অসম সহ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে বা কাশ্মীরে চালু রয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন বা ‘আফস্পা’, যা যে কোনও নাগরিককে বিনা বিচারে পীড়ন বা হত্যার অধিকার দেয়।
যদি ভারতে মৃত্যুদণ্ড উঠে যায়, এ সব ভয়ানক ‘বিশেষ’ আইন বাতিল হবে কি? না কি আইনি পদ্ধতিতে শাস্তি দেওয়া যাবে না বলে, ‘সংঘর্ষ মৃত্যু’র সংখ্যা লাফ দিয়ে বাড়বে? তার মানে এই নয়, মৃত্যুদণ্ডের মতো জঘন্য শাস্তি মেনে নিতে হবে, বা রাষ্ট্রের স্বৈরাচার মানতে হবে। গ্রিক পুরাণের সিসিফাসের মতোই, বিফল হব জেনেও, লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। বলার শুধু এইটুকু, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চর্চা বা প্রয়োগের মধ্যে এর সমাধান হওয়ার নয়। তার জন্য এই প্রতর্ককে রাষ্ট্রীয় পরিধির ‘বাইরে’ নিয়ে যেতে হবে। সে অবশ্য এক ভিন্ন আলোচনার পরিসর, অন্য গল্পের আসর।
শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক