স্বাতন্ত্র্যের পরীক্ষা

স্কুলশিক্ষার প্রকরণ লইয়া সিদ্ধান্তের দায় শিক্ষা দফতরের। স্কুলশিক্ষার সহিত যুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, জাতীয় নীতি এবং বিভিন্ন রাজ্যের নীতি, এবং সমীক্ষা ও গবেষণার ফল বিচার করিয়া নির্ধারণ করিতে হইবে, পাশ-ফেল আদৌ পড়ুয়াদের শিক্ষার মানে উন্নতি করিতে পারিবে কি না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

স্কুলে পাশ-ফেল প্রথা ফিরিবে কি না, মুখ্যমন্ত্রীর উপর সে বিষয়ে সিদ্ধান্তের দায় ন্যস্ত করিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। আনুগত্যের পরীক্ষায় তিনি হয়তো বাড়তি নম্বর পাইলেন, কিন্তু ফেল করিল তাঁহার দফতর। স্কুলশিক্ষার প্রকরণ লইয়া সিদ্ধান্তের দায় শিক্ষা দফতরের। স্কুলশিক্ষার সহিত যুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, জাতীয় নীতি এবং বিভিন্ন রাজ্যের নীতি, এবং সমীক্ষা ও গবেষণার ফল বিচার করিয়া নির্ধারণ করিতে হইবে, পাশ-ফেল আদৌ পড়ুয়াদের শিক্ষার মানে উন্নতি করিতে পারিবে কি না। শিক্ষাবিজ্ঞান একটি নির্দিষ্ট বিষয়, যাহা শিক্ষাদানের পদ্ধতি ও কার্যকারিতা, বিভিন্ন বয়সের শিশুদের শিখিবার ক্ষমতা, তাহাদের মনস্তত্ত্ব ও বৌদ্ধিক বিকাশের সহিত স্কুলশিক্ষার সাযুজ্য, এই বিষয়গুলি লইয়া চর্চা করে। বিকাশ ভবনে যে বিশেষজ্ঞরা মতামত জানাইয়া গেলেন, তাঁহাদের এ বিষয়ে কতটা অধিকার, জানা নাই। কিন্তু
পাশ-ফেল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত লইবার কাজটি ভিন্নমতের মধ্যে সমন্বয় সাধনের কাজ নহে, ইহা সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে নীতি প্রণয়নের কাজ। বিশেষজ্ঞ ও প্রশাসকদের কাজ। রাজনৈতিক নেতৃত্ব নীতির রূপায়ণের পথ নির্দিষ্ট করিতে পারেন, এইটুকু মাত্র।

Advertisement

কিন্তু এখন স্থূলতার যুগ। সরকার কী করিতে পারে আর কী পারে না, সেই বোধ যেন দ্রুত হইতে দ্রুততর গতিতে অবলুপ্ত হইতেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাতন্ত্র্য পার্থবাবু স্বীকার করেন না। তিনি ইতিপূর্বেই স্পষ্ট করিয়াছেন, সরকার যেহেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার টাকা দেয়, তাই সরকারই তাহাদের বিষয়ে সকল সিদ্ধান্ত লইবে। সেই সিদ্ধান্তের পরিসর তিনি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা হইতে স্কুলে পঠন-পাঠনের নীতি অবধি প্রসারিত করিলেন। এই চিন্তার সূত্র ধরিয়া আগাইলে অচিরে স্কুলের অঙ্কের পাঠ্যক্রম, ইংরেজির শিক্ষাপদ্ধতি, বাংলার প্রশ্নপত্র, সব কিছুর জন্য নবান্নের দিকে তাকাইয়া বসিয়া থাকিতে হইবে। এই চিন্তাটি ভ্রান্ত এবং ক্ষতিকর। শিক্ষার উৎকর্ষের অন্যতম শর্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাতন্ত্র্য।

কথাটি কলিকাতায় ফের মনে করাইলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রাক্তন প্রধান বেদ প্রকাশ। তাঁহার বক্তব্য, উচ্চশিক্ষার মানে উন্নয়নের জন্য কেবল পাঠ্যক্রম নির্ধারণের স্বাধীনতাই যথেষ্ট নহে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপে স্বাতন্ত্র্য প্রয়োজন। বেদ প্রকাশ উদাহরণ দিয়াছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য আছে বলিয়াই সেখানকার কোনও অধ্যাপক স্বচ্ছন্দে সরকারের প্রস্তাবের বিরোধিতা করিতে পারে, ‘না’ বলিতে পারে। ভারতে এই স্বাধীনতা ক্রমশ হারাইয়াছে। অমদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য পঙ্কজ চন্দ্র একটি সাম্প্রতিক বইয়ে লিখিতেছেন, ১৯১৬ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধনে আসিয়া মোহনদাস গাঁধী সমবেত মহারাজা এবং ব্রিটিশ কর্তাদের তীব্র সমালোচনা করিয়াছিলেন। তাহার চার বছর পর ফের আমন্ত্রিত হইয়া ওই ক্যাম্পাস হইতেই বিদেশি শিক্ষা বয়কটের ডাক দিয়াছিলেন। তাহাতে তৎকালীন উপাচার্যের চাকরি যায় নাই। আর আজ ছাত্রেরা একটি সরকার-বিরোধী মিছিল করিলে শিক্ষাকর্তারা ফোন করিয়া উপাচার্যকে ধমকাইয়া দেয়, ‘শো-কজ’ তলব করে। শিক্ষার এই সংস্কৃতি বদল না হইলে শিক্ষার মানে উন্নতি হইবে কি?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement