শ্রীনিকেতনে বার্ষিক উৎসবে আনাজের প্রদর্শনী। ছবি: লেখক
‘শ্রীনিকেতন’— ‘শ্রী’ অর্থাৎ ‘লক্ষ্মী’ এবং ‘নিকেতন’ অর্থাৎ ‘নিবাস’। গ্রাম তথা হৃতশ্রী পল্লিজীবনে গ্রামবাসীদের জীবন ও জীবিকার আর্থিক উন্নয়ন ও চাষাবাদ, কুটির শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সবকটি দিকে গ্রামের ‘শ্রী’ ফিরিয়ে আনাই ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান লক্ষ্য। ‘নিকেতন’ কথার অর্থ ‘গৃহ’— অর্থাৎ তিনি বিশ্বাস করতেন, আত্মশক্তি একমাত্র গড়ে তুলতে পারে সুন্দর একটি গৃহ। তিনি অনুধাবন করেছিলেন, ‘মাতৃভূমির যথার্থ স্বরূপ গ্রামের মধ্যেই; এইখানেই প্রাণের নিকেতন; লক্ষ্মী এইখানেই তাঁহার আসন সন্ধান করেন’।
এই শ্রীনিকেতন আজ ভারতবর্ষের গ্রামভাবনা, সমবায়নীতি, বৃক্ষরোপণ বা বনসৃজন অথবা মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর বুনিয়াদি বিদ্যা পরিকল্পনার প্রধান উৎস। ১৯২১ সালে ২৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে সর্বমানবের ও বিচিত্র বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পরের বছর (ফেব্রুয়ারি ৬, ১৯২২/ মাঘ ২৩, ১৩২৮ বঙ্গাব্দ) রবীন্দ্রনাথ সুরুল গ্রামে পল্লী উন্নয়ন বিভাগের সূচনা করেন। পরবর্তী কালে যার নামকরণ হয় ‘শ্রীনিকেতন’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষাদান ব্যবস্থাকে কার্যকরী করার জন্য শান্তিনিকেতনের পরিপূরক রূপে গড়ে তুলেছিলেন এই শ্রীনিকেতন। সহায়তা পেয়েছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদার ছাড়াও কালীমোহন ঘোষ, কাসাহারা সান, আর্থার গ্রেডিস এবং বিশেষ করে লেনার্ড নাইট এল্ম হার্স্টের। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, জীবনে শান্তি তখনই বিরাজ করে, যখন লক্ষ্মী বা শ্রী থাকেন সাথে সাথে— পেটের অন্ন, পরনের বস্ত্র ও মনের শান্তিই তো মানুষের প্রথম ও প্রধান কাম্য। কবি বিশ্বাস করতেন, গ্রামই হল প্রাণের নিকেতন— গ্রামই আমাদের দেশের ধাত্রী এবং গ্রাম না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এমন একজন মনীষী, যিনি এক দিকে মানবজাতির কল্যাণ করতে চেয়েছিলেন, অন্য দিকে মানবজাতির অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা নিয়ে ভেবেছেন এবং তার প্রাসঙ্গিক ক্রমোন্নতির পথনির্দেশ করেছেন। শ্রীনিকেতন রবীন্দ্রনাথের এমনই এক চিন্তাপ্রসূত ফলশ্রুতি। ১৯৪০ সালে শ্রীনিকেতন শিল্পভাণ্ডার উদ্বোধন অভিভাষণ (রবীন্দ্র-রচনাবলী, ১৫শ খণ্ড, পৃ.৫৩২) দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘‘আজ বিজ্ঞানের শিক্ষাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে, এ কথা ভুললে চলবে না আমরা যেন পরাশ্রয়ী জীবের মতো বসে না থাকি। আমাদের অন্নবস্ত্রের জোগান দিচ্ছে কৃষক-শ্রমিক, বিনিময়ে আমরা কি দিচ্ছি তাদের— এ কথা অবশ্যই ভাবতে হবে।’’ গ্রামোন্নয়ন সম্পর্কে কবির (শ্রীনিকেতনের ইতিহাস ও আদর্শ; পল্লীপ্রকৃতি, পৃ.৩৭৭) বক্তব্য, ‘‘আমি একলা সমস্ত ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিতে পারব না, আমি কেবল জয় করব একটি বা দুটি গ্রাম।... আমি যদি কেবল দুটি-তিনটি গ্রামকেও মুক্তি দিতে পারি অজ্ঞতা, অক্ষমতার বন্ধন থেকে, তবে সেখানেই সমগ্র ভারতের একটি ছোট আদর্শ তৈরী হবে... ।’’
রবীন্দ্রনাথের এই গ্রামোন্নয়ন ভাবনা শুধুমাত্র সাহিত্যে প্রকাশ পায়নি, শ্রীনিকেতন প্রকল্পের মাধ্যমে তার বাস্তব রূপদানেও সক্রিয় হন। গ্রামোন্নয়নে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ দূর করতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব অনুধাবন করে শ্রীনিকেতনের বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে একটি গ্রামীণ মেলার আয়োজন করেন, যেখানে বিনোদনকে স্থান দেন। রবীন্দ্রনাথ এই প্রসঙ্গে এল্ম হার্স্টকে লেখেন, (Poet and Plowman, page 12), ‘… I hope, you will establish an annual Mela (fair) of your own at Surul and encourage the holding of lantern lectures and of games during it as well as the usual dramas and dance.’
রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়নের ভাবনা ১৯২২ সালে অকস্মাৎ উদিত হয়নি। পল্লিজীবন সম্পর্কে তিনি প্রথম অভিজ্ঞতা লাভ করেন মাত্র ১৯ বছর বয়সে, ১৮৮০ সালে পৈতৃক জমিদারি দেখতে শিলাইদহ পতিসরে। সেখানে প্রজাকল্যাণের এই কাজের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের শ্রীনিকেতনের কর্মযজ্ঞের বীজ লুকিয়ে ছিল। শ্রীনিকেতন প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি গ্রামোন্নয়নের যে সকল কর্মসূচি গ্রহণ করেন, সেগুলির অন্যতম —(১) স্বদেশি শিল্পজাত দ্রব্য প্রচলন। এগুলি সুলভ ও সহজপ্রাচ্য করার জন্য ব্যবস্থা এবং সাধারণ ও স্থানীয় শিল্পোন্নতির চেষ্টা। (২) আদর্শ কৃষিক্ষেত্র ও খামার স্থাপন এবং গ্রামবাসীকে কৃষিকর্ম বা গো-মহিষাদি পালন দ্বারা জীবিকা উপার্জনোপযোগী শিক্ষাপ্রদান ও কৃষিকর্মের উন্নতিসাধন।
‘শ্রীনিকেতন’ নামে আদর্শ পল্লিপুনর্গঠন ও কৃষি বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ২৩-২৫ মাঘ (ইংরেজি ৬--৮ ফেব্রুয়ারি) শ্রীনিকেতনের প্রধান কার্যালয়ের সম্মুখস্থ প্রাঙ্গণে মহাসমারোহ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় এবং এই উৎসব উপলক্ষে একটি মেলা বসে। আজ, বুধবার সেই মেলা শুরু হচ্ছে। স্থানীয় গ্রামবাসীদের কাছে এই মেলা উক্ত স্থানের নামানুসারে ‘শ্রীনিকেতন মেলা’ বা মাঘ মাসে অনুষ্ঠিত হয় বলে ‘মাঘ মেলা’ নামেও পরিচিতি লাভ করেছে। ময়রা, তেলেভাজা, জিলিপি, লোহা-পিতল-কাঁসা-মাটির তৈরির দ্রব্যাদি ছাড়াও এই মেলার প্রধান আকর্ষণ কৃষি সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি, কৃষিজাত ও শিল্পজাত দ্রব্য ইত্যাদি। এই মেলা ‘কৃষি-শিক্ষা-স্বাস্থ্য মেলা’ নামে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে।
মেলাটি মূলত গ্রামীণ। ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই উৎসব ও মেলা পরিচালনার খরচ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদনক্রমে বিশ্বভারতীর বাজেটে স্থান পেলেও, ২০১৬ থেকে শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট এই মেলার খরচ-বহনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। মেলা উপলক্ষে হয় মহিলা সম্মেলন, শিশু প্রদর্শনী, গ্রাম-কর্মি সম্মেলন, গ্রামীণ কবি ও সাহিত্যিক সম্মেলন। মেলার অন্য আকর্ষণ ব্রতী ও যুব সম্মেলন এবং তাদের ক্রীড়াকৌশল প্রদর্শন। গ্রামের পরিবেশের সামঞ্জস্য রেখে গ্রামের শরীর ও মনের উৎকর্ষসাধন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমাজসেবার আদর্শে উদ্বুব্ধকরণ এই মেলার এক অন্যতম লক্ষ্য। চিত্তাকর্ষক কৃষি ও শিল্প প্রদর্শনীতে নয়নাভিরাম লোভনীয় তরিতরকারি, ফুলফল সকলের বিস্ময় বাড়ায়। দ্রুত পরিবর্তনশীলতার মধ্যেও এখনও গ্রামবাসীদের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে প্রদর্শনীতে রাখা হয় হাঁস, মুরগি, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, চামড়ার দ্রব্যাদি। পরীক্ষামূলকভাবে চার্টের মাধ্যমে মৎস্যচাষ, চাষে সারের ব্যবহার ইত্যাদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়াও থাকে মাটি পরীক্ষার ব্যবস্থা।
সব মিলিয়ে মেলাটি বাস্তবিকই একটি চমৎকার মিলনক্ষেত্র— এখানে পল্লিশ্রীর রূপ, গ্রামলক্ষ্মীর রূপ ফুটে ওঠে। আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চাষের এবং অন্যান্য পণ্যের মানোন্নয়নের বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রামের চাষিরা জানতে পারেন। গ্রামীণ যুগচর্চিত সংস্কৃতি ও কৃষ্টি এই গ্রামীণ মেলায় তুলে ধরা হয়। গ্রাম ও শহর— দুই-ই এই মেলা থেকে সমান ভাবে উপকৃত হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘মেলা ভারতের পল্লীর সর্বজনীন উৎসব। কোনো উৎসব প্রাঙ্গনের মুক্ত অঙ্গনে সকল গ্রামবাসীর মনের উচ্ছ্বসিত মিলনক্ষেত্র হইল মেলা’— তা এই শ্রীনিকেতন বার্ষিক উৎসবে সার্থকতা লাভ করেছে।
(লেখক বিশ্বভারতীর পল্লী সম্প্রসারণ কেন্দ্রের গবেষক ও পল্লী সংগঠন বিভাগের গ্রন্থাগারকর্মী, মতামত নিজস্ব)