বাজেট পরছেন অরুণ জেটলি। ছবি: পিটিআই।
বহু বছর আগে মার্কিন অর্থনীতিবিদ অ্যালিন ইয়ং এক চমৎকার সূত্র বাতলেছিলেন। কোনও দেশে যখন শিল্প-আলোড়ন দানা বেঁধে ওঠে, একইসঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু কলকারখানার গোড়াপত্তন হয়, উৎপাদন বাড়ে, বিনিয়োগ বাড়ে, তখন সেই শ্রীবৃদ্ধির ফলেই যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার মোড় সম্পূর্ণ ফিরে যায় তা নয়, কিন্তু সেই তীব্র কর্মব্যস্ততা, কর্মসংস্কৃতির ফলে আবহাওয়াটা বদলে যায়। ‘কারখানার নিঃশ্বাসে আকাশ আরক্ত হয়ে আসে’। সাধারণ লোকের দক্ষতা, সাহস, ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা বাড়ে। হতাশা থেকে আশার জন্ম হয়। জাতীয় উন্নয়নের এই যে গোপন কাঠি, ইয়ং তার নাম রেখেছিলেন ‘পোটেনশিয়াল ইনডিভিসিবিলিটি’।
নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর বিগত প্রায় দু’বছরে গোটা সমাজ জুড়ে নানা ঘটনায় এক ধরনের হতাশার জন্ম হয়েছে। আন্তর্জাতিক আর্থিক মন্দা, শেয়ারবাজারের সূচক বহু দিন ধরে নিম্নগামী। প্রধানমন্ত্রী বার বার বিকাশের কথা বলছেন। কিন্তু জেএনএইউ বা হায়দরাবাদের ঘটনা সেই আর্থিক বিকাশ ও উন্নয়নের আশাব্যঞ্জক ছবিতে বাদ সাধছে। এই সার্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটি তাই সর্বদাই খুব জরুরি।
মার্কসবাদী তাত্ত্বিক অশোক মিত্র একদা লিখেছিলেন, অজ পাড়াগাঁ থেকে ধরে এনে একটা হাবা ছেলেকে ব্যস্তমুখর নগরের ভিড়ে ছেড়ে দাও, লেখাপড়া শেখানোর দিকে নজর দেওয়ার দরকার নেই, কারিগরি শিক্ষার ব্যাপারেও না ভাবলে চলবে, শুধু সে ঘুরে বেড়াক, নগরের রাস্তাঘাটে, দেখুক গাড়ি-বাড়ি, বিদ্যুতের ঝলক। এক মাসের মধ্যে অন্য মানুষ হয়ে যাবে সে। তার চলনে-বলনে-বুদ্ধিতে উজ্জ্বলতা ছুঁয়ে যাবে, তার দক্ষতা বাড়বে অনেক গুণ। এটাই potential indivisibility। অর্থনীতিকে বলা হয় হতাশার বিজ্ঞান। কিন্তু আসলে জাতীয় চেতনায় সুদৃঢ় আশাবাদ সঞ্চার করতে না পারলে দেশের ধনসম্পদ, দেশের লোকের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন, শিল্পবাণিজ্যের উন্নয়ন— সবই হয়ে যাবে অসম্ভব।
অরুণ জেটলি ঠিক এই রকম এক হতাশাব্যাঞ্জক পরিস্থিতির মধ্যে বাজেট পেশ করেছেন। কাজটা তাই সহজ এ কথা তো কিছুতেই বলা যাবে না। বরং মনে হচ্ছে বাজেটের মাধ্যমে তিনি এক মধ্যপন্থা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ভোটপ্রচারের সময় জগদীশ ভগবতীর মতো অর্থনীতিবিদদের ধারণা হয়েছিল, মোদী ক্ষমতায় আসার পর বোধহয় আমেরিকার রিপাবলিকান দলের এক ভারতীয় অধ্যায় শুরু হতে চলেছে। বাস্তবে কী দেখা গেল? বাস্তবে দেখা গেল প্রধানমন্ত্রীও আর্থিক সংস্কার ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে ভারসাম্যই রক্ষা করতে চাইছেন। ১৯৯১ সালে মনমোহনের অর্থনীতিকে অনেকে ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু সেই আর্থিক সংস্কার হয়তো সময়ের দাবি ছিল। কিন্তু দেখুন, সেই মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রী হয়ে কী করলেন। যাঁরা মনে করেন সনিয়া গাঁধীর জন্য বামপন্থী সামাজিক দায়বদ্ধতা রক্ষিত হয়। কিন্তু বাস্তব হল, মনমোহন নিজেও ’৯১ সাল থেকে এসে ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময়ের মধ্যে অনেকটাই বদলেছেন।
এটাই হল বাজেটের রাজনীতি। বিমল জালান বলেছেন politics trumps economics। তিনি বলছেন, ভারতীয় সংবিধানের ৭৫(৩) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একটা মৌলিক নীতি— সেটা হল মন্ত্রিসভা সংসদের কাছে সমবেত ভাবে দায়বদ্ধ। (The council of ministers shall be collectively responsible to the house of the people)। বহু ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রনেতাদের সংসদকে এড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ইচ্ছে হয়। বিমল জালান বলেছেন, টু’জি কেলেঙ্কারির সময়েও এমনটাই হয়েছিল। প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও বার বার দেখি তিনি সংসদের বাইরে অর্ডিন্যান্স সই করার পক্ষে নন। সংবিধান মেনে শেষ পর্যন্ত তিনি সই করতে বাধ্য। কিন্তু করতে চান না।
স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর নেহরু যুগ শুরু হওয়ার পর ক্রমশ মানুষের মোহভঙ্গ হয়। অসন্তোষ বাড়তে থাকে। রাজনীতিতে সফলতা মানে হাতে ক্ষমতা পাওয়া, রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পাওয়া মানে সোনার কাঠি-রূপোর কাঠির সাহায্যে শাসক শ্রেণিকে পুষ্ট করবে। সেই সময়ে যে নিরুৎসাহ বোধ এসেছিল তা কিন্তু ভারতীয় অর্থনৈতিক বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে লক্ষ্য তেমন উঁচু নয়, আশাভঙ্গের সম্ভাবনাও সেখানে কম। যেমন, ভারতে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এই লক্ষ্যমাত্রা স্থাপনে নেহরুর বিনয় ও পরিমিতি বোধ ছিল। আজ ২০১৬ সালের চৌকাঠে দাঁড়িয়েও মনে হচ্ছে, সরকারের এই বিনয় ও পরিমিতি বোধের প্রয়োজন। মিডিয়ার যুগে ঢক্কানিনাদ জরুরি হতে পারে, তবু সে তো কঠিন। তবু সে করে না বঞ্চনা।