ধাত্রীদেবতা সংস্কারের পরে। ছবি: লেখক
বহু স্মৃতিবিজড়িত আমোদপুর থেকে কাটোয়া পর্যন্ত ছোট লাইনের ট্রেন এখন উধাও। এখন ব্রডগেজ রেললাইন। যদিও ট্রেন চলে মাত্র একটি। বীরভূমের সেই ‘গঞ্জ’ লাভপুর এখনও শহর হিসেবে তকমা না পেলেও লাভপুরে কলেজ হয়েছে। এখন অনেক সুদৃশ্য দালানবাড়ি হয়েছে লাভপুরে। কলকাতা থেকে আমোদপুর স্টেশনে নেমে লাভপুরের বাড়িতে যেতেন কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তারাশঙ্করের সময় লাভপুর নেহাতই অনামী গ্রাম ছিল। এই গ্রামেই তাঁর সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি। লাভপুর এবং সংলগ্ন এলাকার মানুষ আর মানুষের সুখ-দুঃখের কথাই উঠে এসেছে তারাশঙ্করের সাহিত্যে। সেই হাঁসুলীবাঁক এখনও আছে। বয়ে যায় তেমনই কোপাই নদী। শুধু সেই বনোয়ারী – করালী এখন আর নেই। একদা জমিদারশাসিত লাভপুর এখন পঞ্চায়েতের অধীনে। সতীপীঠ ফুল্লরা আর লেখক তারাশঙ্করের ভিটের মাটি ছুঁতে এখনও প্রতিদিন লাভপুরে আসেন বহু পর্যটক।
লাভপুরের প্রকৃতি বড় মনোরম। চারিদিকে সবুজ বনানী। আকাশের নীল আর মাটির সবুজ মিশে থাকে দূর দিগন্তে। এখনও অনেক ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে এই গঞ্জে। গঞ্জটির বুক চিরে চলে গিয়েছে রেললাইন। এ গঞ্জ একদা জেলায় নাট্যচর্চায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। বীরভূমে থিয়েটার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ নির্মলশিব বন্দ্যোপাধ্যায় এই গঞ্জের জমিদার বংশের উত্তরসূরী। নির্মলশিব লাভপুরে গড়ে তুলেছিলেন নাটকের দল। এখান থেকেই প্রকাশ করতেন ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকা। তারাশঙ্করকে তিনি তাঁর সকল কাজের সঙ্গী করেছিলেন। নির্মলশিবের নাটক তখন কলকাতার মঞ্চে অভিনীত হত। নির্মলশিবের প্রেরণায় গাঁয়ের ছেলে তারাশঙ্কর মেতেছিলেন নাট্যচর্চায়। লাভপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অতুলশিব ক্লাব। পরে ক্লাবের সঙ্গেই অতুলশিব মঞ্চ। সেই অতুলশিব ক্লাবের নানা নাটকে তারাশঙ্কর নানা চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এমন কি নারী চরিত্রেও অভিনয় করেছেন বেশ কিছু নাটকে। সেই অতুলশিব ক্লাব শতবর্ষ অতিক্রম করেছে। পাশেই গ্রন্থাগার। আর শতবর্ষ ছুঁই ছুঁই অতুলশিব নাট্যমঞ্চ। ১৯২১ সালে রাস পূর্ণিমায় যে মঞ্চের উদ্বোধন করেছিলেন রসরাজ অমৃতলাল বসু। পরে যে মঞ্চে পা রেখেছেন নাটকের জগতের অপরেশ মুখোপাধ্যায়, শিশির ভাদুড়ি, নরেশ মিত্র, তিনকড়ি চক্রবর্তী প্রমুখ। লাভপুরের নাটুকে মানুষ মহাদেব দত্ত, জমিদার বংশের প্রতিনিধি সুব্রতনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্যোগ নিয়ে নবকলেবর দিয়েছেন অতুলশিব মঞ্চের। নির্মলশিবের ছেলে সত্যনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তুখোড় অভিনেতা। আর এক ছেলে নিত্যনারায়ণ ভাল নাটক, গল্প লিখতেন। সত্যনারায়ণই ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় তারাশঙ্করকে সহ-সম্পাদক করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তারাশঙ্কর তখন কবিতা লিখতেন। সেই লাভপুরে এখন থিয়েটারচর্চার উত্তরসূরী হিসেবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী আর দিশারী সাংস্কৃতিক চক্র। দিশারী পঁচিশ বছর ধরে তারাশঙ্করের গল্পাশ্রিত নাটক করে চলেছে। প্রতিবার তারাশঙ্করের জন্মদিনে সেই নাটক মঞ্চস্থ হয় অতুলশিব মঞ্চে। একদা তারাশঙ্কর স্বয়ং যে মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন।
১৯০৫ সালে এই লাভপুরে থিয়েটারের দলের নাম ছিল বন্দেমাতরম থিয়েটার। গ্রন্থাগারের নাম ছিল বন্দেমাতরম গ্রন্থাগার। লাভপুরের তৎকালীন লেখক কবি নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় ধ্বনিত হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
বন্দেমাতরম থিয়েটার পরে হল অন্নপূর্ণা থিয়েটার। এ সবের অগ্রদূত ছিলেন নির্মলশিব। নাটক লিখতেন, অভিনয় করতেন, কবিতা লিখতেন, পত্রিকা প্রকাশ করতেন। এই নির্মলশিবের ছত্রচ্ছায়ায় তারাশঙ্করও নাটকে মেতেছিলেন। অবশ্য পরবর্তীতে সাহিত্যই হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রধান উপজীব্য। কিন্তু কেউ কি ভেবেছিলেন, এই গঞ্জ লাভপুরের তারাশঙ্করের মাথায় একদিন উঠবে ‘জ্ঞানপীঠ’-এর মুকুট! কেউ কি ভেবেছিলেন, এই এলাকার মাটি ও মানুষের কথা লিখে তিনি হবেন রাঢ় বাংলার কথাকার!
বারবার নিজের গ্রামটিতে ফিরেছেন তারাশঙ্কর। জমিদার বংশের উত্তরাধিকার ছিলেন তিনিও। কিন্তু গ্রামে এসে মিশে যেতেন সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে। তাঁরাই হয়ে উঠতেন তাঁর সাহিত্যের চরিত্র। লাভপুর এলাকার মাটিতে লালিত ভাদুগান, বোলানগান, টুসু, কবিগান, ভাজোগান, হাপুগান আকৃষ্ট করেছিল তারাশঙ্করকে। নিতাই কবিয়াল, পংখে, বিশু ডাক্তার, রংলাল ডাক্তার, জগন্নাথ, বনোয়ারী, করালীদের তিনি সৃষ্টি করেছিলেন বাস্তবের অস্তিত্ব থেকে। এখনও তারাশঙ্কর সাহিত্যের চরিত্র বিশু ডাক্তার (ডা: সুকুমার চন্দ্র) প্রতিদিন লাভপুরে নিজের চেম্বারে রোগী দেখেন। তারাশঙ্কর তাঁকে গ্রামে ডাক্তারি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ‘জগন্নাথের রথ’ গল্পের জগন্নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমীহ করে লাভপুরের মানুষ। এই লাভপুরের ডা: বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়, প্রবীণ অভিনেতা হরিপ্রসাদ সরকার, অশীতিপর চিকিৎসক সুকুমার চন্দ্র, জগন্নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতির ঝুলিতে তারাশঙ্কর সান্নিধ্যের সুবর্ণ স্মৃতিগুলি যত্নে রাখা আছে। হরিপ্রসাদ সরকার অভিনয় করেছেন তারাশঙ্করের সঙ্গে। লাভপুরের মহাদেব দত্ত হাঁসুলীবাঁকের উপকথা, ধাত্রীদেবতা, গণদেবতা, কবি নাটকে তারাশঙ্কর সৃষ্ট বহু চরিত্রে অভিনয় করে মঞ্চ মাতিয়েছেন। অকালপ্রয়াত অভিনেতা শশাঙ্ক সরকার মঞ্চে যেন তারাশঙ্কর সৃষ্ট সত্যিকারের পাতু বায়েন বা পংখে হয়ে উঠতেন। সংলগ্ন এলাকার প্রথিতযশা বাউল কার্তিক দাস, আবসার হোসেনরা গান গাইতে বসলেই শ্রোতারা অনুরোধ করেন, ‘মধুর মধুর বংশী বাজে কোথা কোন কদমতলীতে...’ গাইতে। এ গান যে তারাশঙ্করের লেখা। কার্তিকদাস বাউল ‘কবি’ নাটকে নিতাই কবিয়াল হয়ে বহুবার মঞ্চ মাতিয়েছেন। এভাবেই আজও লাভপুরে তারাশঙ্করের গ্রামে তারাশঙ্কর আছেন।
তারাশঙ্কর যখন পঁচিশের চৌকাঠে (১৩৩০ সন) তখনই শুরু হয়েছিল ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকার পথচলা। প্রতি পূর্ণিমায় বসত ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকার সাহিত্যসভা। সেখানে লেখা পড়তেন তারাশঙ্কর। সাহিত্যের টানে বিভিন্ন সময় লাভপুরে এসেছেন সজনীকান্ত দাস, জলধর সেন, বনফুল, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী নজরুল, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়।
লাভপুরে অতুলশিব মঞ্চটি নির্মিত হয়েছিল (১৯২১ খ্রীষ্টাব্দ) কলকাতার পার্শী থিয়েটার এরিন্থিয়ান থিয়েটারের অনুসরণে। একদা লাভপুরে নাটকের তরুণ তুর্কী আশিস মান্না আজ আর নেই। ডায়মন্ড ক্লাব নেই। নেই সপ্তর্ষি নাট্য ইউনিট। কিন্তু দিশারী আছে। বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী আছে। দিশারীর কর্ণধার নাট্য পরিচালক পার্থপ্রদীপ সিংহ জাতীয় শিক্ষক। বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় ‘ধর্মমঙ্গল’ নাটক প্রযোজনা করে নাট্যমহলে আলোড়ন তুলেছেন। এখনও নিয়মিত এখানে বসে তারাশঙ্কর সাহিত্যসভা। যা হয়তো সেই পূর্ণিমা সাহিত্য সম্মেলনের স্মৃতি বহন করে চলেছে। তারাশঙ্করের কাছারিবাড়ি ‘ধাত্রীদেবতা’ এখন তারাশঙ্কর বিষয়ক সংগ্রহশালা। অচিরেই জেলা পরিষদের উদ্যোগে নবকলেবর পাবে তারাশঙ্কর স্মৃতিবিজড়িত ধাত্রীদেবতা। এই সংগ্রহশালায় আছে তারাশঙ্কর ব্যবহৃত আসবাবপত্র, ঘড়ি, পান্ডুলিপি, পদক, তারাশঙ্করের হাতে আঁকা ছবি, কাটুম কুটুম। তারাশঙ্করের পৌত্র অমলশঙ্কর এখানে প্রাণিত শক্তি। সংগ্রহশালার দায়িত্বে আছে বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী।
তারাশঙ্করের জন্মদিনে প্রতিবছর ৮ই শ্রাবণ এই ধাত্রীদেবতার মাটি ছুঁতে আসেন জেলার সাহিত্যসেবীরা। সকালে প্রভাতফেরি দিয়ে শুরু হয়। এরপর সারাদিন তারাশঙ্কর সাহিত্যের আলোচনা, তারাশঙ্করের রচনাশ্রিত নাটক, গ্রন্থপ্রকাশ, তারাশঙ্করের সূতিকাগৃহে পুষ্পাঞ্জলি- একের পর এক অনুষ্ঠান চলতে থাকে। তারাশঙ্কর শতবর্ষের কয়েক বছর আগে কাজটা শুরু করেছিল লাভপুরের মানুষকে নিয়ে জেলার ‘দিদিভাই’ পত্রিকা। এখন সেই অনুষ্ঠান হয় সরকারি তত্বাবধানে। একসময় জেলা বিদ্যালয় পর্ষদও আয়োজন করেছে তারাশঙ্কর তর্পণের। তারাশঙ্করের আত্মজ সরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আসতেন প্রতি বছর। এখন থাকেন তারাশঙ্করের ভ্রাতুষ্পুত্র বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা থেকে আসেন আর এক ভ্রাতুষ্পুত্র চিত্র পরিচালক পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠান হয় ধাত্রীদেবতা প্রাঙ্গণে ও অতুলশিব মঞ্চে।
৮ শ্রাবণ মানে বীরভূমে তারাশঙ্কর তর্পণের দিন। গান – কবিতা – নাটকে তারাশঙ্কর চর্চা। লাভপুরের প্রবীণ – নবীন মানুষেরা মিলেমিশে যান তারাশঙ্করের নামে। লাভপুরের মানুষ মানেন স্রষ্টার অমরত্ব সৃষ্টিতেই। আর এবারেও সেই উৎসবে হয়তো তারাশঙ্কর তর্পণ অনুষ্ঠানে কার্তিকদাস বাউল হারমোনিয়াম ধরলেই শ্রোতারা নিশ্চয় আর্জি জানাবেন, ওই গানটা, ওই যে — ‘মধুর মধুর বংশী বাজে কোথা কোন কদমতলীতে....’
লেখক প্রাক্তন কলেজ গ্রন্থাগারিক ও সাহিত্যকর্মী।