জামাটা নিয়ে এসে খুলে দেখলাম। একটা দারুণ জামা। চারটে পকেট। পকেটের ওপর ঢাকনা। জামাটা নাড়ালেই চিকচিক করছে। কোথাও কোথাও আলো জ্বলছে। মখমলের মতো নরম। বালিশের নীচে লুকিয়ে রাখলাম। রাতে ঘুম আসছিল না। অত সুন্দর একটা জামা বালিশের নীচে রেখে শুয়ে আছি বলে কি না জানি না।
Durga Puja 2021

সেই জামা আর অর্ধেক বাদাম

Advertisement

সুবোধ সরকার

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২১ ০৮:২৬
Share:

ছবি: কুনাল বর্মণ

আমি তখন কৃষ্ণনগর কলেজিয়েটে পড়ি। ক্লাস সিক্সে। থাকি নতুন পল্লির পুকুরপাড়ের ভাড়াবাড়িতে। স্নান করতে পয়সা লাগে না, ঝপাং করে জলে আছড়ে পড়লেই হল। বাড়ির সামনে খেজুর গাছে উঠে ঝাঁপ দিতাম জলে। তার পর ঘণ্টাখানেক সাঁতার। জল থেকে উঠতে ইচ্ছে করত না। খেতে পয়সা লাগে। ঘুমোতে পয়সা লাগে। জেগে থাকতে পয়সা লাগে। অত পয়সা পাব কোথায়? বাবা পাবনা থেকে মায়ের হাত ধরে পালিয়ে আসা শরণার্থী। বহু কষ্টে একটা মাথা গোঁজার জায়গা তখনও খুঁজে চলেছেন। আমার জন্মের পর পাঁচ-ছ’টা বাড়ি হয়ে গেল। কোথাও থিতু হতে পারিনি। এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় আমাদের ছাদবদল হয়েই চলেছে। রায়পাড়া থেকে নতুনপল্লি, নতুনপল্লি থেকে চৌধুরীপাড়া, চৌধুরীপাড়া থেকে মল্লিকপাড়া, মল্লিকপাড়া থেকে পাত্র মার্কেট।

Advertisement

আমার ছোটবেলার কৃষ্ণনগরে পুজো কাটত ঝড়ের গতিতে। হাতে একটা পয়সাও ছিল না। এক ঠোঙা বাদাম কেনার পয়সা ছিল না। কিন্তু আশ্বিন মাসের গন্ধ পেতাম সারা কৃষ্ণনগর জুড়ে। সেই গন্ধ এখনও আমার নাকে ফিরে আসে পুজোর সময়ে। সেই গন্ধের জন্য কোনও পয়সা লাগত না। মাথার ওপর তাকালেই শরতের মেঘ। সেই অপূর্ব মেঘ দেখতে পয়সা দিতে হত না। এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম ঠাকুর দেখতে। হাঁটতে কোনও পয়সা লাগে না। হাতারপাড়া, চাষাপাড়া, রায়পাড়া, কাঁঠালপোঁতা, ষষ্ঠীতলার পুজো ছিল মারকাটারি। এক পাড়ার সঙ্গে আর এক পাড়ার সে কী রেষারেষি! এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ! এ যদি একশো আটখানা ঢাক আনে তো ও আনবে দুশো দশটা! গোটা শহরটাই হয়ে উঠত ঢাক বাজানোর কম্পিটিশন।

সে বার আমার পুজোর জামা হবে কি হবে না, ঠিক ছিল না। পুজোয় তা হলে কী পরে ঘুরব? পুজোর সময়ে আমি তো আর সারাক্ষণ পুকুরের জলে ডুবে থাকতে পারি না! বন্ধুদের তিনটে-চারটে করে জামা হয়েছে। সে সব জামা দেখেও ফেলেছি। কিন্তু আমার মনখারাপ হয়নি। হবে কেন? আমার খুব বন্ধু ছিল অজয়। কে সেই অজয়? আজও তার মায়াময় মুখ আমার মনে চিরস্থায়ী হয়ে আছে। অজয়ের সঙ্গে আমি দাবা খেলতাম। ওই একটা খেলাই খেলতে পারত অজয়। কেননা অজয় দাঁড়াতে পারত না। বসতেও পারত না। অজয় শুয়ে থাকত। বাইরের ঘরে একটা খাটে তাকে শুইয়ে রেখে যেত বাড়ির লোকেরা। কোমর থেকে প্যারালিসিস ছিল। বিধান রায় দেখে বলে দিয়েছিলেন, চোদ্দো বছর বয়সে মারা যাবে। তার সামনে ছিল একটা জানালা। সেই জানালা দিয়ে সে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করত। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চাল দিতাম। আর অজয় শুয়ে শুয়ে চাল দিত। আমি হেরে যেতাম বারবার। হেরে গেলেই অজয় বলত, “আর একটা দান হয়ে যাক। এ বার তুই জিতবি।” কখনও কখনও ও আমাকে জিতিয়ে দিত। একটা হেরে যাওয়া ছেলে একটা সুস্থ সবল সাঁতার কাটা ছেলেকে জিতিয়ে দিত। কার কাছ থেকে সে বার খবর পেল, আমার পুজোর জামা হয়নি। ষষ্ঠীর দিন সকালে (তখন ষষ্ঠীর দিনটাকে আমরা পুজো বলে মানতাম না, এখন যেমন মহালয়া থেকেই সপ্তমী) অজয় আমাকে দাবায় হারিয়ে হঠাৎ বলল, “তোর জন্য একটা গিফট আছে।” একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল ও। আমি বললাম, “এটা কী?” অজয় বলল, “কাল পরবি। জামাটা তোকে দারুণ মানাবে।”

Advertisement

আমি জামাটা নিয়ে এসে খুলে দেখলাম। একটা দারুণ জামা। চারটে পকেট। পকেটের ওপর ঢাকনা। জামাটা নাড়ালেই চিকচিক করছে। কোথাও কোথাও আলো জ্বলছে। মখমলের মতো নরম। বালিশের নীচে লুকিয়ে রাখলাম। রাতে ঘুম আসছিল না। অত সুন্দর একটা জামা বালিশের নীচে রেখে শুয়ে আছি বলে কি না জানি না। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। ভোরের দিকে একটা স্বপ্ন দেখলাম। আকাশ থেকে একটা জামা নেমে আসছে। জামায় লাগানো অনেক নক্ষত্র। সেগুলো জ্বলছে আর নিভছে। আমি ধরতে গেলাম। ধরতে পারলাম না। জামাটা আমার হাতের কাছাকাছি এসে হুশ করে উড়ে গেল পাবনা জেলার দিকে। আর আমি দেখতে পেলাম, পাবনা জেলার ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসছে আমার বাবা। বাবার পেছনে পেছনে আমার মা। ঘুম ভেঙে গেল। আমি লাফ মেরে বিছানায় বসে, বালিশের নীচে হাত দিলাম। হ্যাঁ, জামা আছে। পাবনায় উড়ে যায়নি।

বিকেলে জামাটা পরে বেরোলাম। মা বলল, “এই জামা তুই কোথায় পেলি?” আমি বললাম “অজয় দিয়েছে। অজয় অনেক পেয়েছে, ও তো আর ঠাকুর দেখতে যায় না। একটা আমায় দিয়েছে।” মা বলল, “ভেতরে আয়।” আমি ভেতরে গেলাম। মা আমার হাতে পাঁচ আনা দিল। বলল, “বাদাম কিনে খাস।” কী আনন্দ, কী আনন্দ! সে দিন পাড়ার মণ্ডপে এক ঠোঙা বাদাম কিনে খেতে খেতে মনে হয়েছিল, আমার চাইতে বেশি সুখী আর কেউ নেই পৃথিবীতে। আমি অর্ধেক বাদাম পকেটে রেখে দিলাম অজয়কে দেব বলে। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম ঘূর্ণী। সেখানে কয়েকটা ঠাকুর দেখার পর আমার জামার হাতার দিকে চোখ গেল। এটা কী করে হল? পুরো জামাটার রং ছিল নীল। সেটা কী করে হলুদ হয়ে গেল? আমি আবার মন দিয়ে দেখলাম, জামার রং হলুদ হয়ে গেছে। এ আবার হয় নাকি? এ বার আমার মনে হল— নীল নয়, হলুদ জামাই পেয়েছি। আবার হাঁটতে হাঁটতে আমি নেদেরপাড়ায় এলাম ঠাকুর দেখতে। নেদেরপাড়ার মণ্ডপ থেকে যখন বেরুচ্ছি, তখন আমার ক্লাসের এক বন্ধু দাঁড়িয়ে ছিল। সে খুব অবাক হয়ে বলল, “কী ব্যাপার রে, তুই মণ্ডপে ঢুকলি হলুদ জামা পরে, এখন বেরিয়ে এলি সবুজ জামা পরে?” আমি নিজের জামার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। সত্যি সত্যিই সবুজ! আমি নিজেকে ফিসফিস করে বললাম, এটা কী হচ্ছে? এ রকম হয় নাকি? আমার মনে হল, জামাটা খুলে ফেলি। কিন্তু খালি গায়ে যদি বাড়ি ফিরি, পাড়ার লোকে বলবে কী!

এ তো মহা মুশকিলে পড়া গেল! আমি বেজিখালির কাছে পাওয়ার হাউসের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বোঝালাম, আমার তো কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। জামা নীল হলে নীল। জামা হলুদ হলে হলুদ। জামা সবুজ হলে সবুজ। ভাবতে ভাবতেই জামাটার রং মেরুন হয়ে গেল। আমি মনে মনে বললাম, আমার বন্ধুদের তিনটে করে জামা হয়েছে পুজোয়। আমি এক দিনেই চারটে জামা পরে ঘুরে বেড়ালাম। খারাপ কী?

ফেরার পথে সেই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। অজয় মাথা তুলে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি অজয়ের দিকে ঠোঙাটা এগিয়ে দিলাম, “আমি খেয়েছি, তোর জন্য অর্ধেকটা এনেছি।” অজয় বলল, “এতক্ষণ আমার সপ্তমী হয়নি। এ বার আমার সপ্তমী হল। জামাটা তোকে দারুণ মানিয়েছে। কী সুন্দর লাগছে!” আমিও অজয়কে বললাম, “তোকেও খুব সুন্দর লাগছে রে!” ওর দেওয়া জামাটা যে আসলে চারটে জামা, সেটা আর ওকে বললাম না। ও বিশ্বাস করবে না। যার একটা জামাও জুটছিল না, তার চার-চারটে জামা হয়ে গেল।

এটা কি মা দুর্গার ম্যাজিক?

আজও তার উত্তর মেলেনি। ছোটবেলায় কৃষ্ণনগরে পুজোর সময়ে এ রকম আরও সব ঘটনা ঘটত, যার ব্যাখ্যা পাইনি আজও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement