মতাদর্শগত এবং গুণগত শ্রীবৃদ্ধি কি দলে অগ্রাধিকার পাবে?

সময়ের সঙ্গে উপযোগী করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার অভ্যন্তরীণ দলীয় গণতন্ত্র। কলকাতা প্লেনামে এসে লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালকমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে এই প্রথম প্লেনামের শেষ দিনটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে সাংবাদিকদের জন্য। একটা সময় ছিল যখন বৃহৎ সংবাদপত্র ও মাধ্যম ছিল বুর্জোয়া প্রেস এবং ত্রহ্যস্পর্শ। সময় বদলেছে। সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বললেন, ‘‘সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে আমরা সাধারণ মানুষকে জানাতে চাই প্লেনাম ব্যাপারটা কী। সেখানে নেতানেত্রীরা কী বলছেন, কী করছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫ ০১:২৩
Share:

কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে এই প্রথম প্লেনামের শেষ দিনটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে সাংবাদিকদের জন্য। একটা সময় ছিল যখন বৃহৎ সংবাদপত্র ও মাধ্যম ছিল বুর্জোয়া প্রেস এবং ত্রহ্যস্পর্শ। সময় বদলেছে। সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বললেন, ‘‘সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে আমরা সাধারণ মানুষকে জানাতে চাই প্লেনাম ব্যাপারটা কী। সেখানে নেতানেত্রীরা কী বলছেন, কী করছেন। প্লেনাম ও পার্টি কংগ্রেসের তফাত কী, সেটা অনেক মানুষ জানেন না। পার্টি কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়, সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন, রাজনৈতিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক, সাংগঠনিক নীতি প্রণয়ণ হয়। কিন্তু, প্লেনাম ব্যাপারটা হল মূলত অভ্যন্তরীণ দলীয় সাংগঠনিক। দলীয় দুর্বলতা অতিক্রম করার সাংগঠনিক ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করা।’’

Advertisement

এ বার প্লেনাম দেখতে কলকাতায় এসেছি। গণতান্ত্রিক পথে দলকে উন্মুক্ত করা মানুষের সামনে এটা এক দিনে হয়নি। সল্টলেকে দ্বাদশ পার্টি কংগ্রেসে সাংবাদিকদের ফিশ ফ্রাই খাইয়ে নিয়মিত সাংবাদিক বৈঠক করে দলের অনেক কথাই বাইরে প্রকাশ করে দেওয়া হয়েছিল। অনিল বিশ্বাস মৃত্যুর আগে এক বার দলের জেনারেল বডির বৈঠকে সাধারণ মানুষদের আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। পরিবর্তন অনেক হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৮ সালের সালকিয়া প্লেনামে দলের বৃদ্ধি নিয়ে যে দুঃখপ্রকাশ করা হয়েছিল, সেই দুঃখটাই কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির অপরিবর্তনীয় বিষয় হিসেবে রয়ে গিয়েছে। গোটা দেশে দলের সুসম বিকাশ আজও হয়নি। সালকিয়া প্লেনাম হয়েছিল ২৭ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৭৭। এর পর ৩৮ বছর পর সেই একই দিনগুলিতে সিপিএমের প্লেনাম হচ্ছে কলকাতায় প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে।

সে দিন দল তখন সবে প্রথমবারের জন্য ক্ষমতাসীন হয়েছিল এ রাজ্যে, আর আজ সেই সিপিএম ৩৪ বছর একটানা রাজ্যপাট করে ভোটে প্রত্যাখাত হয়ে গত সাড়ে বছর ধরে এখন বিরোধী দল। কিন্তু ৩৮ বছর আগে যে সব সাংগঠনিক দুর্বলতা ও বিচ্যুতিকে সালকিয়া প্লেনাম চিহ্নিত করেছে, আজ প্রায় চার দশক পর দল সেগুলিকে কতখানি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে, দলের মধ্যেই সেটাই সবথেকে বড় প্রশ্ন।

Advertisement

সীতারাম ইয়েচুরি এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

প্লেনাম আজ এমন একটা সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। দলের কিছু প্রবীণ নেতা মনে করছেন, প্লেনাম পার্টি কংগ্রেস নয়। প্লেনামে অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করে রাজ্য থেকে জেলা, জেলা থেকে ব্রাঞ্চ, রিপোর্ট সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক রণকৌশল ঠিক করাটাই সবথেকে বড় কাজ। কিন্তু এখন ভোটের মুখে যেন তেন প্রকারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতাচ্যুত করাটাই মুখ্য বিষয় হয়ে উঠছে। আপাতত প্রচারেরও প্রধান বিষয় হল রাজ্যে সিপিএম কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়ায় যাবে কি যাবে না।

প্রকাশ কারাট এবং কেরল-অন্ধ্রের বেশ কিছু নেতা প্রশ্ন তুলছেন, সালকিয়া প্লেনামে দল বলেছিল, কংগ্রেস হল এক আধা-ফাসিস্ত দমন-পীড়নকারী দল। বুর্জোয়া জমিদারদের দল। আবার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ঘোষণাও ছিল। এবং ৩৮ বছর আগের রিপোর্টে লেখা হয়েছিল যে প্রকৃত বিকল্প কোনও বাম ও গণতান্ত্রিক বিকল্প। বহু নেতারই আজ প্রশ্ন, সে দিন যাদের সংশোধনবাদী বলা হয়েছিল, দল কি এখন তাদের সঙ্গেই হাত মেলাতে প্রস্তুত?

সেই সংশোধনবাদী কংগ্রেস দলের শ্রেণিচরিত্র কি বদলে গিয়েছে? সিপিএম নেতারা বলছেন, আসলে যে পটভূমিতে সে দিনের প্লেনাম হয়েছিল, সেই রাজনৈতিক পটভূমিটাই বদলে গিয়েছে। সালকিয়া প্লেনামে বলা হয়েছিল, ’৬৪ সালে সংশোধনবাদীদের সঙ্গে দল বিচ্ছেদ ঘটায়। আবার ১৯৬৮ সালে বামপন্থী হঠকারীদের ‘সংহতি নাশক কার্যকলাপ’ রাজ্যে পার্টি সংগঠনকে গুরুতর ভাবে দুর্বল করে দেয়। আসলে ১৯৬৪তে সিপিআইয়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ আর ’৬৮-তে নকশালদের সঙ্গে দৌরাত্ম্য শুরু হয়েছিল। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি আর চিনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের সঙ্গে ‘আমাদের পার্টিকে তীব্র লড়াইয়ে নিযুক্ত হতে হয়েছিল’। এ দিকে তার পর ’৭৫ সালে ইন্দিরা গাঁধীর জরুরি অবস্থা। সেই পটভূমিতে ’৭৭ সালে কংগ্রেস বিরোধিতার প্রাসঙ্গিকতা ছিল। কিন্তু এখন বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক শক্তির যে উত্থান, সেটা মোকাবিলা করার জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা প্রয়োজন।

বিমান বসু, সীতারাম ইয়েচুরি, সূর্যকান্ত মিশ্র, মহম্মদ সেলিম

কিন্তু বহু নেতা সালকিয়া প্লেনামের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলছেন, সে দিন বলা হয়েছিল দলের সবথেকে বড় সমস্যা হল গোটা দেশে তার অসম বিকাশ। শুধু পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও ত্রিপুরায় নয়। গোটা দেশ জুড়ে দলের বিকাশ না হলে সর্বভারতীয় সংগঠন তৈরি হবে না। সেটা না হলে কখনও অ-কংগ্রেসি, কখনও অ-বিজেপি শক্তির লেজুড়বৃত্তি করা যায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী বৃদ্ধি ঘটে না। সালকিয়া প্লেনামে বলা হয়েছিল, ‘বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনে যে সময়ই লাগুক, আর একে বাস্তবায়িত করতে যত বাধাই আসুক, আর কোনও বিকল্প পথ নেই। কোনও শর্টকাট খুঁজে পাওয়া যাবে না। কংগ্রেস দলের ৩০ বছর বুর্জোয়া-জমিদার শ্রেণি এবং গত ২১ মাস ধরে জনতা দলের সেই একই শ্রেণি শাসন নিঃসন্দেহে প্রমাণ করছে, এই শ্রেণিশাসন দেশের কোনও মূল অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। এ দেশে কোনও স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও নিশ্চিত করতে পারে না।’

সে দিন নাম্বুদ্রিপাদ, সুরজিৎ, রণদিভে, বাসবপুন্নাইয়া প্রমুখ নেতারা মনে করেছিলেন দলকে ফেডেরালিজম-এর ঝোঁক থেকে বের করে এনে শক্তিশালী পার্টি কেন্দ্র তৈরি করে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতিকে বাস্তবায়িত করে যদি পার্টির বিরাট অসম বিকাশ দূর করা সম্ভব হয়, তা হলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। আজ এতো বছর পর সুরজিতের হাত থেকে প্রকাশ কারাট দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি দশ বছর ক্ষমতাসীন ছিলেন। তার পর মশাল হাতে নিয়েছেন সীতারাম ইয়েচুরি। প্রশ্ন উঠছে, এই সর্বভারতীয় পরিস্থিতির কোনও বদল কেন হল না? সে দিনের নেতারা কিন্তু আশঙ্কা করেছিলেন, যদি অন্য রাজ্যগুলিতে সংগঠন না বাড়ে তা হলে পশ্চিমবঙ্গের উপর বুর্জোয়া জমিদারি আক্রমণ এলে তখন কিন্তু এই ‘স্ট্র্যাটেজিক’ এলাকার বাইরে থেকে (যেমন, হিন্দিভাষী এলাকা) কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে না। তখন পশ্চিমবঙ্গেও বিপদ বাড়বে। সে দিনের প্রবীণ নেতাদের ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়েছে। কিন্তু সালকিয়া প্লেনামের গৃহীত পথনির্দেশিকা দিশা হারিয়েছে মরুপথে। সালকিয়া প্লেনাম দলের বৃদ্ধির সমস্যার অশণি সঙ্কেত দেখেছিল। তার পরেও দলে সংখ্যা বেড়েছে। গুণগত মান সেভাবে উন্নত হয়নি। পরবর্তী পার্টি কংগ্রেসগুলিতেও তার স্বীকৃতি আছে। সালকিয়া প্লেনামের রিপোর্ট দীর্ঘ দিন ধরে দলে ছাপাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখনও দলের বহু নেতা এই রিপোর্টকে সেই ভাবে গুরুত্ব দিতে রাজি নন। কিন্তু মূল প্রশ্নটা প্লেনামের শুরুতেই অনেকেই উত্থাপন করছেন। কংগ্রেসের সঙ্গে কোনওক্রমে জোট বাঁধাটাই কি দলের একমাত্র মোক্ষলাভের পথ? না কি গোটা দেশ জুড়ে মতাদর্শগত এবং গুণগত শ্রীবৃদ্ধি হওয়া উচিৎ দলের অগ্রাধিকার? সময়ের সঙ্গে উপযোগী করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার অভ্যন্তরীণ দলীয় গণতন্ত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement