আমার ছেলে বাংলা ছাড়া সবেতেই ভাল নম্বর পায়— কথাটির মধ্যে যে কেন বাঙালি এতটা গর্ববোধ করেন, তা বোঝা খুবই দুষ্কর৷ অথচ, এই বাংলাভাষার সেবা করেই বিশ্বে নজির গড়েছেন কত জন৷ বিবেকানন্দ সে অর্থে সাহিত্যিক ছিলেন না। কিন্তু বাংলাভাষাকে একটা পরিশীলিত রূপদানে তাঁর অবদান অসীম৷ বাংলা গদ্যের গতিরূপ নির্মাণ করেছেন তিনি৷ তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধগ্রন্থে যে ভাবে তিনি বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করেছেন, তাতে বলতেই পারি ভাষার আধুনিকীকরণ ঘটিয়েছেন তিনি৷
জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা শব্দ দু’টিকে একই সুতোয় গেঁথেছিলেন বিবেকানন্দ৷ তিনি মূলত ভারতীয় নাগরিক হলেও মানসিক ভাবে ছিলেন বিশ্বনাগরিক৷ তাই বিশ্বের যে কোনও প্রান্তের অধিবাসীই তাঁর ভগ্নী ও ভ্রাতৃপ্রতিম৷ উদার মানবতার মন্ত্রে দীক্ষিত এই বিশ্বপথিক বাংলাভাষা তথা বাঙালি সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে সমুজ্জ্বল করেছেন৷ আন্তরিক দেশপ্রীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর তেজস্বিতা, সাহসিকতা, বাগ্মিতা ও আধ্যাত্মিকতা ৷ প্রবল দেশপ্রেমই তাঁর মধ্যে ভারতীয় ঐতিহ্য সচেতনতাও দান করেছিল৷ ভারতীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন তথা ভারতীয়ত্বের বোধ দ্বারা জারিত হয়েছিলেন বলেই তাঁর বিশ্বৈক্যবোধের সুরটি সহজেই ধ্বনিত হয়েছে৷
এহেন বিবেকানন্দের পক্ষেই ১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার শিকাগোয় এক আন্তর্জাতিক ধর্ম মহাসভায় এই মন্তব্যটি করা সম্ভব হয়েছিল— ‘‘আমার আমেরিকাবাসী ভগ্নী ও ভ্রাতৃগণ’’। সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিই মানবসমাজকে বারে বারে ধ্বংসের মুখে এগিয়ে দিয়েছে৷ এই সত্যটি উপলব্ধি করেছিলেন বলেই ধর্মান্ধতা দূর করে সংস্কারমুক্ত মানবতাবাদে সমৃদ্ধ এক সমাজব্যবস্থা গঠনে সচেষ্ট থেকেছেন বিবেকানন্দ৷ যে কাজে তিনি সহায় হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন যুবসমাজকে৷ সমাজকে আলোর পথযাত্রী করতে তিনি কলম ধরলেন। বাংলা গদ্য মাধ্যমেই মূলত সমাজকে সচেতন করে তুলতে চাইলেন তিনি৷ যদিও এই বীর সন্ন্যাসীর কিছু কবিতাও রয়েছে, যা মানবাত্মার জাগরণ ঘটানোর মন্ত্রে স্নাত৷ মানবজাতির কল্যাণে পুরুষের সঙ্গে নারীরও সমান মর্যাদার কথা বলেছিলেন তিনি৷ তিনি লিখছেন— ‘‘জগতের কল্যাণ স্ত্রীজাতির অভ্যুদয় না হইলে সম্ভাবনা নাই, এক-পক্ষ পক্ষীর উত্থান সম্ভব নহে৷ সেইজন্যই রামকৃষ্ণাবতারে স্ত্রীগুরু গ্রহণ— সেইজন্যই নারীভাবসাধন— মাতৃভাবপ্রচার— সেইজন্যই আমার স্ত্রী মঠ স্থাপনের জন্য প্রথম উদ্যোগ—উক্ত মঠ গার্গী, মৈত্রেয়ী এবং তদপেক্ষা আরও উচ্চতর ভাবসম্পন্না নারীকুলের আকরস্বরূপ হইবে৷’’
বাঙালির মনোজগৎকে সঠিক পথের দিশা দেখাতেই তিনি বাংলা সাহিত্যে অংশ নিয়েছিলেন৷ সাহিত্য দর্শন ও ইতিহাসের প্রতি তিনি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন৷ বাংলাভাষার সমৃদ্ধি ঘটাতে তিনি ১৩০৫ সনের ১ মাঘ রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের একমাত্র বাংলা মুখপত্র ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার প্রবর্তন করেছিলেন৷ বাংলা ভাষার সাহিত্য সৃষ্টি আনুমানিক ৯০০ সাল থেকে শুরু হলেও দীর্ঘ দিন পদ্যমাধ্যমেই তা বন্দি ছিল৷ এই বন্ধনদশা দূর হয়েছে উনিশ শতকে৷ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের লেখকদের অবদান এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য৷ ইতিপূর্বে দলিল দস্তাবেজ বা চিঠিপত্রে গদ্য প্রচলিত থাকলেও সাহিত্যে গদ্যকে আশ্রয় করা হয়েছে উনিশ শতকেই৷ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের উইলিয়ম কেরি এবং মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বিশেষ ভাবে স্মরণীয়৷ কারণ, তাঁরা মানুষের মুখের ভাষাকে সাহিত্যে নিয়ে এসেছিলেন৷ তার পর কালীপ্রসন্ন সিংহ ও প্যারীচাঁদ মিত্রের দ্বারা বাংলা সাহিত্য আরও কিছুটা গতিলাভ করে৷
বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা যেমন বক্তব্য পরিবেশনে, বিষয় উপস্থাপনে তেমনই গদ্যমাধ্যমে তার প্রকাশ রীতিতেও— যা উনিশ শতকেই আমরা পেয়েছি৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে জাত এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই প্রয়াত বিবেকানন্দের মধ্যে ছিল বাংলা ভাষার প্রাণ স্পন্দনটিকে গদ্যমাধ্যমে ধরার যথার্থ ক্ষমতা৷ বাংলা সাহিত্যেও তিনি যৌবনের গতিবেগ সঞ্চারিত করলেন চলিত বাংলার আশ্রয়ে৷ বেদান্তের মধ্যে যে আত্মসত্য প্রতিষ্ঠার কথা রয়েছে, তা-ই স্বামীজির মনে আশাবাদ বপণ করেছিল৷ সেই আশাবাদের মধ্যে দেশপ্রেমের মন্ত্র এসে মিশেছিল৷ যা কিছু জীবন্ত তথা চলমান, তার মধ্য দিয়েই তিনি ব্রহ্মের প্রকাশ দেখতে পেতেন৷ তাই হয়তো তাঁর বক্তব্যের মধ্যে যে গতিবাদের সমর্থন তার উপযুক্ত ভাষা হিসেবে তিনি চলিত গদ্যের আশ্রয় নিয়েছেন৷ চলিত বা মুখের ভাষা সাহিত্যে প্রয়োগে সাহিত্যের ভাষাকেও আরও গতিশীল বা প্রাণময় করে তোলা যায়৷ বিবেকানন্দ মনে করতেন, ভাষা খুব সরল হওয়া প্রয়োজন; যাতে ভাব অবাধে প্রকাশ পায় ভাষাকে তেমন সহজবোধ্য হতে হবে৷ বাংলা গদ্যে কথ্যরীতি প্রয়োগে তিনি— ‘পরিব্রাজক’, ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’, ‘ভাববার কথা’ ইত্যাদি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন৷ এ ছাড়া ‘পত্রাবলী’তেও তিনি কথ্যভাষার প্রয়োগ ঘটান৷ তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা৷ সেটা এক দিকে যেমন নিজ দেশীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা তেমনই পাশ্চাত্য সম্পর্কেও জ্ঞানলাভ করা৷ সেই জন্যই সাধারণ মানুষের সঙ্গে যাতে সহজেই যোগাযোগ স্থাপিত হয়, তাই ভাষাটিকেও সেই মতোই তিনি ব্যবহার করেছিলেন৷
স্বল্পায়ু বিবেকানন্দ যে সময়ে সাহিত্যে কথ্যরীতিকে এনেছেন তখনও কিন্তু ‘সবুজপত্র’ নিয়ে প্রমথ চৌধুরীর আবির্ভাব ঘটেনি৷ রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীর পূর্বে বাংলা চলিত ভাষার এমন প্রাণৈশ্বর্য, এমন সুষমা স্বামীজি ভিন্ন আমরা পাই না৷ তাই তাঁর ভাষা আজও এমন বাঙ্ময়৷ তাঁর মতে, সাহিত্যবস্তু মানুষের জীবন থেকেই উঠে আসে৷ তাই জীবনের সঙ্গে সাহিত্যের জীবন্ত সম্পর্ক ধরতে চাইলে কথ্যরীতিতেই তা উপস্থাপিত হওয়া প্রয়োজন৷ এ ক্ষেত্রে স্বামীজির বক্তব্যটি এই রকম—‘‘স্বাভাবিক যে ভাষায় মনের ভাব আমরা প্রকাশ করি, যে ভাষায় ক্রোধ-দুঃখ-ভালবাসা ইত্যাদি জানাই, তার চেয়ে উপযুক্ত ভাষা হতে পারেই না; সেই ভাব সেই ভঙ্গি, সেই সমস্ত ব্যবহার করে যেতে হবে৷.... আমাদের ভাষা সংস্কৃতর গদাইলস্করি চাল, ঐ এক চাল নকল করে অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে৷ ভাষা হচ্ছে উন্নতির প্রধান উপায়, লক্ষণ।’’
জীবনের প্রতি প্রবল মমতাময় বলেই স্বামীজি ভাবতে পেরেছিলেন যে, সংস্কৃতপন্থী সাধুভাষা যদি জীবনের যোগ হারিয়ে ফেলে, তবে চলিত ভাষাকেই আশ্রয় করতে হবে৷ যদিও এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য তাঁর 'বর্তমান ভারত' গ্রন্থটি সাধুভাষায় লিখিত হলেও যথেষ্ট প্রাণবন্ত৷ আবার তাঁর ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ গ্রন্থের শুরুতেই তিনি ক্রিয়াপদের বাহুল্যবর্জিত যে গদ্যরূপ অঙ্কন করেছেন, তা প্রায় সংস্কৃতেরই অনুরূপ৷ এ ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, অত্যন্ত বিচক্ষণ ছিলেন বলেই তিনি ভাষাকে তাঁর বক্তব্যের উপযোগী করে ব্যবহার করেছেন৷ তাঁর মন্তব্যটি একটু উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করি— ‘‘ভাষা এমন হওয়া চাই যাহাতে ভাব অবাধে প্রকাশ পাইতে পারে।’’
স্বামীজির ‘পরিব্রাজক’ গ্রন্থে তাঁর দ্বিতীয় বার আমেরিকা যাত্রাকালীন জলপথে ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা আছে৷ গ্রন্থটিতে তাঁর বর্ণনা শক্তির গুণে পাঠকেরও যেন সমুদ্র ভ্রমণ হয়ে যায়৷ এক দিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা, অন্য দিকে মানবজীবনের বৈচিত্র্য তথা ইতিহাসের গতিধারার কথা পাঠককে সমৃদ্ধ করে৷
বিবেকানন্দের কথ্যরীতির আর একটি লক্ষণীয় বিষয় হল, মাঝে মাঝেই সংস্কৃত সমাসবদ্ধ পদের ব্যবহার৷ অনায়াসেই তিনি ব্যবহার করতে পারেন ‘‘কণপ্রত্যাশী মৎসকুল’’ কিংবা ‘‘অনন্তশষ্পশ্যামলা সহস্রস্রোতস্বতীমাল্যধারিণী’’ ইত্যাদি বাক্যাংশ, যা চলিত ভাষার মধ্যেই৷ কিন্তু ভাষা কোথাও এতটুকু ভারসাম্য ক্ষুণ্ণ করে না৷ বরং ওই জাতীয় বাক্যাংশ প্রয়োগে ভাষার ওজোগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ তাঁর কথ্যরীতিতে হাস্যরসের অনাবিল প্রবর্তনা আমরা লক্ষ করি৷ তাঁর ‘ভাববার কথা’ গ্রন্থে হাস্যরস সৃজনে তাঁর নৈপুণ্যের দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করি—
‘‘বলি রামচরণ! তুমি লেখাপড়া শিখলে না, ব্যবসা-বাণিজ্যেরও সঙ্গতি নাই, শারীরিক শ্রমও তোমা দ্বারা সম্ভব নয়, তার ওপর নেশাভাঙ্ এবং দুষ্টামিগুলাও ছাড়তে পার না, কি করে জীবিকা কর বল দেখি?’
রামচরণ—‘‘সে সোজা কথা, মশায়— আমি সকলকে উপদেশ করি৷’’
আবার এই চলিত ভাষার প্রয়োগে অত্যন্ত গুরুগম্ভীর ভাবকেও তিনি অনায়াসে ব্যক্ত করেছেন৷ তাঁর ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ গ্রন্থে তিনি লিখছেন—‘‘ধর্ম কি? যা ইহলোক বা পরলোকে সুখভোগের প্রবৃত্তি দেয়৷ ধর্ম হচ্ছে ক্রিয়ামূল৷ ধর্ম দিনরাত খোঁচাচ্ছে, সুখের জন্য খাটাচ্ছে৷ মোক্ষ কি? যা শেখায় যে, ইহলোকে সুখও গোলামি, পরলোকেও তাই, এই প্রকৃতির নিয়মের বাইরে ত এ লোকও নয়, পরলোকও নয়৷’’
জনগণের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার সূত্র ধরেই সাহিত্যে মানুষের মুখের ভাষাকে আনার প্রবণতাটি তাঁর মধ্যে কাজ করেছিল বলে মনে হয়৷ আসলে তাঁর মধ্যে সমাজসংস্কারক মানুষটি বিদ্যমান ছিলেন৷ তাই তাঁর মনে হয়েছিল সকলের সঙ্গেই সহজ যোগাযোগ সৃষ্টি করতে পারে, এমন ভাষাই সাহিত্যে প্রযোজ্য৷ বাংলাভাষার ভয়ঙ্কর দুর্দিন বলে চতুর্দিকে যখন ধ্বনি উঠছে, তখন বড় বেশি করেই মনে পড়ছে বিশ্বজয়ী বিবেকানন্দের বাংলাভাষা চর্চা— যা আমাদের মাতষাষার প্রতি আন্তরিক ভালবাসা বদ্ধির সহায়ক৷
(উদ্ধৃতির বানান অপরিবর্তিত)
শ্রীপৎ সিং কলেজের শিক্ষক