প্রতীকী চিত্র।
সম্প্রতি তেলঙ্গানায় এক তরুণী ধর্ষণ করে পুড়িয়ে মেরে ফেলার অভিযোগে যখন গোটা দেশ ফুঁসছে, সেই সময়ে আবারও উন্নাওয়ের এক ধর্ষিতাকে আদালতে যাওয়ার পথে কেরোসিন তেল ঢেলে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করল ধর্ষণে অভিযুক্তেরা। একের পর এক এই ধরনের ঘটনায় আমরা শিহরিত! কী ভাবে একটা দেশে মেয়েদের ক্রমাগত নারী নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। প্রাণে মেরে ফেলা হচ্ছে! এর শেষ কোথায়?
বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় আজও নৃসংশতার বলি হতে হচ্ছে মেয়েদের। একের পর এক নারকীয় নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসায় বারবার লজ্জায় মাথা হেঁট হচ্ছে। প্রশ্নের মুখে পড়ছে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা। প্রশ্ন উঠছে, কেন আরও কঠোর করা হচ্ছে না ধর্ষকদের শাস্তি? কেন ধর্ষণের শাস্তির বিচার প্রক্রিয়ার এত শ্লথ গতি?
২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের কলঙ্কিত সেই রাত, দিল্লির মুনিরকা এলাকায় চলন্ত বাসে গণধর্ষণের ঘটনায় শিহরিত হয়েছিল গোটা দেশ। ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ছিল গোটা দেশ। উঠেছিল ধর্ষণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি। ধর্ষণকারীদের মধ্যে এক জন নাবালক হওয়ায় দু’বছর হোমে রেখেই ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে। বাকি অভিযুক্তদের ফাঁসির সাজা শোনানো হলেও ঘটনার পর সাত বছর কেটে গিয়েছে। এখনও তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি। নির্ভয়া-কাণ্ডের পর বদলেছে সরকার। কঠোর করা হয়েছে আইন। কিন্তু আজও বন্ধ হয়নি নারীনির্যাতন। সম্প্রতি তেলঙ্গানার হায়দরাবাদের তরুণী চিকিৎসককে গণধর্ষণ করে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় আবারও নতুন করে বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার প্রসঙ্গটিকে খুঁচিয়ে তুলেছে।
ওই একই দিনে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুরে। কোয়েম্বাটুরের পর মহারাষ্ট্রের নাগপুরেও ঘটেছে নাবালিকার উপরে অকথ্য নির্যাতনের ঘটনা। অতিসম্প্রতি কলকাতার কালীঘাটে ফুটপাতে বসবাসকারী দুই নাবালিকাকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে দু’জন নাবালক। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস্ ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে প্রতি মিনিটে এক জন নারী ধর্ষিতা হন। ২০১৭ সালে এনসিআরবি-র পরিসংখ্যানে দেশের মধ্যে নারী নির্যাতনে শীর্ষে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ। সেই উত্তরপ্রদেশ, যেখানে নিজের পিতৃসম বিধায়কের কাছে কাজ চাইতে গিয়ে গণধর্ষিতা হতে হয়েছিল এক নাবালিকাকে। উন্নাও-এর সেই ঘটনার পর গণধর্ষণে অভিযুক্ত বিধায়ক গ্রেফতার হলেও জেলে থেকেই তিনি ওই নাবালিকাকে খুনের একাধিক বার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কাঠুয়া-কাণ্ডে আবার মন্দিরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
আমাদের দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। মহাকাব্য মহাভারতে কৌরবদের হাতে নিগৃহীতা হতে হয়েছিল দ্রৌপদীকে। রামায়ণে বারবার লাঞ্ছিতা হতে হয়েছিল সীতাকে, দিতে হয়েছিল অগ্নিপরীক্ষা। আজও অতীতের ধারা বজায় রেখে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী যেন ভোগ্যপণ্য, খুব সহজেই তাঁকে ভোগ করে নিজের কামবাসনা চরিতার্থ করা যায়! এই ভাবনা থেকেই বাংলার কামদুনিতে ধর্ষিত ও খুন হতে হয়েছিল কলেজপড়ুয়া তরুণীকে। সিঙ্গুরে ধর্ষিতা হতে হয়েছিল তাপসী মালিককে। তোলপাড় হওয়া ওই ঘটনা থেকে পরিবর্তিত হয়েছিল রাজ্য-রাজনীতি। রানাঘাটে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ডাকাতেরা ডাকাতি করতে গিয়ে ধর্ষণ করেছিল বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীকে।
বিকৃতকাম মানসিকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে যে মূক ও বধির, এমনকি, মানসিক ভাসমান্যহীন নারীরাও নিগ্রহের স্বীকার হচ্ছেন। কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে চলন্ত গাড়িতে তুলে ধর্ষণের ঘটনা কয়েক বছর আগে আমাদের শহর কলকাতার নারী নিরাপত্তার ঢিলেঢালা ছবি তুলে ধরেছিল। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে সম্প্রতি কলকাতারই পঞ্চসায়রে। নিরাপত্তা কোথায়?
এই উন্নাওয়ের মেয়েটি, এই তেলঙ্গানার মেয়েটি কিংবা দিল্লির ধর্ষণ-কাণ্ডের মেয়েটির তো কোনও দোষ ছিল না। তবু তাঁদের এ ভাবে অকালে প্রাণ দিতে হবে?
সমস্যা অনেক গভীরে। আমাদের দেশে ‘যৌন' শব্দটাই যেন একটা নিষিদ্ধ শব্দ। রক্ষণশীলতার বেড়া টপকাতে না পেরে আজও অনেকে এই শব্দটাই নাক কুঁচকে ওঠেন। বিদ্যালয় কিংবা কলেজগুলিতেও প্রদান করা হয় না যৌনশিক্ষা। ফলে, মেয়েদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হয়, সেই জ্ঞান থেকে যায় অধরা। বহু ক্ষেত্রে সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যেও বিকৃতকামের প্রবেশ ঘটে। আবারও লাঞ্ছিতা-নিগৃহীতা হতে হয় নারীকে। আর আমাদের এই সমাজ ধর্ষককে সাদরে গ্রহণ করলেও ধর্ষিতাকে তো ততটা সানন্দে গ্রহণ করে না, প্রতিপদে লড়াই সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় তাঁদের। এই লড়াইয়ে কেউ হেরে যান, কেউ আবার জিতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। অতিরিক্ত মাদক আমাদের যুবসমাজকে শেষ করে দিচ্ছে, যে বয়সে কেয়িয়ার তৈরির কথা, সেই বয়সে ধর্ষকে রূপান্তরিত হচ্ছে একটি ছেলে। এর পিছনে রয়েছে অবশ্যই শিক্ষার অভাব। পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব, স্নেহ-ভালবাসার অভাবে নাবালকদের মধ্যেও প্রবেশ করছে বিকৃতকাম। এমনটাই মতো মনোবিদদের।
আমাদের দেশের অনেক সাংসদও ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত। আট থেকে আশি, যে কোনও বয়সী মহিলার ক্ষেত্রে বারবার আঘাত নেমে আসায় নারী নিরাপত্তা দিতে প্রশাসন যে ব্যর্থ, তা প্রমাণিত। সম্প্রতি ওড়িশায় রক্ষকই আবার ভক্ষকের ভূমিকা পালন করেছে! সরকারকে আরও কড়া হতে হবে। ধর্ষণের ঘটনার ছয় মাসের মধ্যে ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতেই হবে। তা না এই তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে।
রানাঘাট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র