কৃষিজমিতে শিল্পের কী হল

অধিগ্রহণের নতুন আইন চাপিয়ে যদি দাম আরও চারগুণ বাড়ানো হয়, আর জমির মালিকদের ভর্তুকি ও বাড়ি দেওয়া হয়, দাম কোথায় পৌঁছয়?

Advertisement

সঞ্জয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৯ ০১:৩৬
Share:

প্রতীকী চিত্র।

কেউ নিশ্চয়ই ভোলেননি, তবু মনে করিয়ে দিচ্ছি। তৃণমূলের উত্থান, সিপিএমের পতন শুরু হয় ২০০৭-এ, নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুরে কৃষিজমি অধিগ্রহণের ফলে। জমি আইন সংশোধন করে, বর্গাদারদের অধিকার আর আয় বাড়িয়ে, কৃষকের বন্ধু হয়ে, টানা সাতটি নির্বাচন জিতে চৌত্রিশ বছর রাজত্ব করেছিল বামফ্রন্ট। কিন্তু শিল্প আসেনি (বস্তুত, পালিয়েছিল), অন্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছিল। শিল্প আকর্ষণের জন্য বামফ্রন্ট নতুন শিল্পনীতি বানিয়ে, সহজে জমি জোগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে, বড় অঙ্কের পুঁজি টানার মরিয়া চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের সামর্থ্য ছিল না, ছিল ঔদ্ধত্য। নন্দীগ্রামে কাস্তে-হাতে চাষি আর সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক জমির মালিকের প্রতিবাদে নকল বুঁদির গড় ভেঙে পড়ে ২০১১ সালে।

Advertisement

বামফ্রন্টের বামে যে জায়গাটি খালি হয় তা দখল করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রথম প্রতিশ্রুতি: জমি অধিগ্রহণ আর হবে না, বেসরকারি তো বটেই, সরকারি প্রকল্পের জন্যেও না। গর্ডিয়ান নট খুলতে গিয়ে আলেকজ়ান্ডার দড়িটা স্রেফ কেটে দিয়েছিলেন তরোয়াল দিয়ে। মমতাও কৃষিজমি সমস্যার সমাধানে জমি অধিগ্রহণ ব্যাপারটাই বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। এ কথা সত্যি যে, তিনি কথা রেখেছেন। অধিগ্রহণ কার্যত বন্ধ। কিন্তু জমি সমস্যার সমাধান হয়েছে না বেড়েছে? এটা আলেকজ়ান্ডারের গিঁট কাটা, না মাথাব্যথা সারাতে মাথা কাটা?

দেশে বিবিধ পরিবর্তনের সঙ্গে জমির বাজারে মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে। সেগুলো বুঝে যথাযথ ব্যবস্থা না করলে রাজ্যের উন্নয়ন অসম্ভব। জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে যে অন্যায় এ রাজ্যে, এ দেশে হয়েছে, উন্নয়নের নামে যে ভাবে কোটি কোটি লোকের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস হয়েছে, তার ক্ষমা নেই। কিন্তু তার বিচার আর মিলবে না। আমাদের জুঝতে হবে এখনকার বাস্তবের সঙ্গে। তিনটি পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে, এবং পারলে তার সুযোগ নিতে হবে।

Advertisement

প্রথমত, গত বিশ বছরে জমির বাজার আমূল পাল্টে গিয়েছে। ২০১৩’য় এসেছে জমি অধিগ্রহণের নয়া আইন। এর ফলে অধিগ্রহণ হলে জমির মালিকের অভূতপূর্ব লাভ হয়, ক্ষতি না। অধিগ্রহণ বন্ধ করলে বরং মালিকের ক্ষতি। দ্বিতীয়ত, দেশে যে কৃষিসঙ্কট, পশ্চিমবঙ্গে তা আরও সঙ্গিন। এ রাজ্যে চাষ থেকে উপার্জন এখন দেশের সর্বনিম্ন। বিহারের চেয়েও কম, পঞ্জাবের দশ ভাগের এক ভাগ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জমি ভাগ হতে হতে টুকরো-টুকরো হয়ে গিয়েছে। গড় আয়তন দু’একরের নীচে। প্রসঙ্গত, সিঙ্গুরের এক হাজার একরের মালিকানা ছিল ষোলোশো লোকের হাতে। এটুকু জমিতে চাষের উপার্জন থেকে সংসার চালানো প্রায় অসম্ভব। অচিরে একেবারেই অসম্ভব হয়ে যাবে।

তৃতীয়ত, যে সব রাজ্যের নেতারা এই টুকরো টুকরো জমি জোড়ার ব্যবস্থা করতে পারবেন, তাতে কারখানাই হোক, বা রাস্তা, বা বাড়ি— তাঁরা পুঁজি ও উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় জিতবেন। জমির মালিক, আর যাঁরা জমি নিয়ে যে কোনও অকৃষি কাজ করতে চান, দুই পক্ষেরই এতে লাভ হবে। যাঁরা ভাবছেন যে বালিতে মাথা গুঁজে রাখলেই, প্রতিযোগিতা উবে যাবে, তাঁরা হারবেন, হারবেন সে রাজ্যের বাসিন্দা।

সব বিতর্ক, ভয় আর সুযোগসন্ধানের শুরু জমির দাম থেকে। অনেক তথ্য ঘেঁটে আন্দাজ করা যায়, সেচব্যবস্থা থাকলে বছরে ত্রিশ হাজার টাকা মিলতে পারে এক একর জমি চাষ করে। ছ’সাত লক্ষ টাকা ব্যাঙ্কে থাকলেই আজীবন এই রোজগারের ব্যবস্থা সম্ভব। সুতরাং স্রেফ চাষ উৎপাদনের হিসেবে দেখলে একর-প্রতি ১০ লক্ষ টাকা যথেষ্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনও এলাকায় এক একর উর্বর চাষজমি কেনা যায় ১০ লক্ষ টাকার কমে, বেশির ভাগ অঞ্চলে (যেমন কানসাস বা ওহাইও-তে) এর চাইতে অনেক কমে। যদিও সে দেশে কৃষিতে উৎপাদনের হার ভারতের চেয়ে বেশি, ফসলের দামও বেশি। সুতরাং শুধুমাত্র উৎপাদনের হিসেবে ভারতে কৃষিজমির

দাম আমেরিকার চেয়ে কম হওয়া উচিত।

একরপ্রতি ১০ লক্ষ টাকার চাইতে বেশি কোনও মতেই হওয়া উচিত না।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই, দেশে কোথাও এখন ১০ লক্ষ টাকায় এক একর জমি কেনা অসম্ভব। ২০০০-১৪ সালের মধ্যে শহরে ও গ্রামাঞ্চলে অন্তত পাঁচগুণ বেড়েছে জমির দাম। বড় শহরের কাছাকাছি এক একর জমির দাম এখন কয়েক কোটি টাকা। শহর থেকে দূরে বহু লক্ষ টাকা। এমনকি সুদূর জঙ্গল এলাকায়ও ১০ লক্ষ টাকার নীচে জমি নেই। আমার হিসেব, ভারতে জমির দাম এখন বিশ্বের শীর্ষে। অপ্রত্যাশিত এবং অভূতপূর্ব এই অবস্থা।

এর ‌উপর অধিগ্রহণের নতুন আইন চাপিয়ে যদি দাম আরও চারগুণ বাড়ানো হয়, আর জমির মালিকদের ভর্তুকি ও বাড়ি দেওয়া হয়, দাম কোথায় পৌঁছয়? ২০০৭-এ বামফ্রন্ট সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ করেছিল গড়ে একরপ্রতি কমবেশি ১০ লক্ষ টাকায়। আজ অধিগ্রহণ করতে একরপ্রতি কমপক্ষে ৬০ লক্ষ টাকা দিতে হবে, ৮০ লক্ষ বা এক কোটিও দিতে হতে পারে। যা চাষ থেকে রোজগারের ১০-১৫ গুণ টাকা। এত টাকা যে পড়শির জমি অধিগ্রহণ হলে (আর নিজেরটা না হলে) হিংসে হবে।

অধিগ্রহণ বন্ধ করে তবে কার লাভ? জমির মালিকের না, জমিহীন কৃষকের না, অধিগ্রহণ করে নতুন পুঁজি যে ঢালতে চায় তার না, উৎপাদনের না, রোজগারের না, উন্নয়নের না। নিন্দুকরা বলবেন, লাভ মুখ্যমন্ত্রীর, তাঁর জেদি ভাবমূর্তির। লাভ দালাল, প্রোমোটার আর সিন্ডিকেটের পান্ডাদের, যারা খুচরো জমির হাতবদলে ওস্তাদ। কেউ অবশ্য বলতে পারেন, এত টাকা কোথায়? সরকারের রাজস্ব নেই এত টাকা দিয়ে জমি অধিগ্রহণের। এ-ও সত্যি। এমনও হতে পারে যে অধিগ্রহণ বন্ধ করার আসল কারণ চাষির সুরক্ষা নয়, সরকারের টাকার অভাব।

মোদ্দা কথা, পুরনো পন্থায় অধিগ্রহণ আর হবে না। জমির দাম আর আইনের জাঁতাকলে ও রাস্তা বন্ধ। নতুন করে ভাবতে হবে, নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। কিছু জমির ব্যবহার না বদলালে যে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানেই থমকে থাকবেন। তা হলে?

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।

(চলবে)

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেম্পল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement