রক্তপলাশের বনে তখন লেগেছিল দোলের রং। শীতের আলস্য দূর করে শুষ্ক প্রকৃতিতে যখন নব উচ্ছ্বাসে, স্পর্ধিত পদক্ষেপে নিজের বর্ণময় উপস্থিতির আভাস দিচ্ছিল মধুমাস বসন্ত, ঠিক তখনই থেমে গিয়েছিল বেশ কিছু কোকিলের গান। ইতিহাস থমকে দাঁড়িয়ে লিখে নিয়েছিল সব কিছু। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি।
একুশ মানে মাথা নত না করা, একুশ মানে অন্যায়কে অমান্য করে গর্জে ওঠা তারুণ্য, যা কুর্নিশ জানায় নিজ ভূমি নিজ ভাষাকে। ওই দিন ঢাকার রাজপথ রক্তাক্ত হয়েছিল বহু মাতৃভাষাপ্রেমী ছাত্র শিক্ষকের রক্তে। আপামর বাঙালির কাছে তাই একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহিদদের প্রতি স্মৃতিতর্পণের দিন। ২২শে ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজারে প্রকাশিত হল সেই মর্মান্তিক ঘটনার বিবরণ—ঢাকায় ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ, ১ জন নিহত, ১৬ জন আহত, ৮ জনের অবস্থা গুরুতর। আনন্দময় ফাগুনের দিনে ঘাতকের বেয়নেটের সামনে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়েছিলেন রফিক, জব্বর, বরকত শেফিউরদের মতো নির্ভীক তরুণের দল। কী ছিল তাঁদের দাবি, যার জন্য জীবনকে বাজি রাখতেও তাঁরা দ্বিতীয় বার ভাবেনি।
কারণ অনুসন্ধানের জন্য পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কয়েকটি বছর। ১৯৪৮ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মহম্মদ আলি জিন্না এই মর্মে নির্দেশ জারি করলেন যে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দূ। দেশের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলিও জিন্নার সঙ্গে সহমত পোষণ করে বললেন, পাকিস্তানের ১০ কোটি মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাষা উর্দূ। একটি জাতির জন্য একটি ভাষা থাকা প্রয়োজন এবং এই ভাষা কেবল উর্দূ হতে পারে, অন্য কোনও ভাষা নয়। কিন্তু এই স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলেন পাকিস্তান পার্লামেন্টের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি অধিবাসীরা। শ্রীদত্ত সংশোধনী প্রস্তাব এনে বাংলাভাষাকেও যুক্ত করার কথা বললেও তা অচিরেই প্রত্যাখ্যান করা হয়। সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে নিজ দাবি আদায়ে ব্যর্থ হতাশ ধীরেন্দ্রনাথ যখন করাচি থেকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করলেন, তখন তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনা পঞ্চাশেক ছাত্র তেজগাঁও বিমানবন্দরে পুষ্পবর্ষণের মাধ্যমে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
যে কোনও জাতির অস্মিতা প্রকাশ পায় নিজ ভাষায়, নিজ সংস্কৃতির মাধ্যমে। তাই মানবজীবনে ভাষার ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ভাষা না হলে নেশান বা জাতি গঠিত হয় না এবং ভাষা সম্বন্ধে সচেতন না হলে জাতীয়তাবোধও আসে না। হৃদয়ের অন্তঃস্থলে আজন্মলালিত সেই প্রাণের ভাষার সম্মানরক্ষার তাগিদেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সালারের বাবলা গ্রামের বরকতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বেলডাঙার কাজিশাহ গ্রামের সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক আনোয়ার পাশা। এ ছাড়াও বিশিষ্ট অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সন্তোষ ভট্টাচার্য প্রমুখও সামিল হয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনের তুমুল জোয়ারে। অমূল্য প্রাণ বলিদান করেছিলেন শুধু মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসার টানে। বহু মহিলাও রক্ষণশীলতার বন্ধন ছিন্ন করে ভাষা আন্দোলনের জন্য পথে বেরিয়ে এসেছিলেন। যেমন নারায়ণগঞ্জের একটি স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা মমতাজ বেগম। কারাবন্দি অবস্থায় মুচলেকার বিনিময়ে তাঁকে মুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিল স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু তিনি তাতে রাজী না হওয়ায় স্বামী তাকে তালাক দেন। বেগম সুফিয়া কামাল, বেগম রোকেয়া প্রমুখ নারীদেরও বাংলা ভাষাপ্রীতির জন্য অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
যার কণ্ঠে প্রথম ধ্বনিত হয়েছিল ভাষাবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, পঁচাশি বছর বয়সে সেই ধীরেন্দ্রনাথ এবং তাঁর ছোট ছেলে দিলীপ দত্তকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়।
একুশে ফেব্রুয়ারি অশ্রুসিক্ত ইতিহাস প্রতি বছর বাঙালি মননে স্মরণ করিয়ে দেয় মাতৃভাষার প্রতি নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। কিন্তু অসমের বরাক উপত্যকায় স্বাধীন ভারতের সরকারের পুলিশের গুলিতে নিহত ১১ জন ভাষা শহিদের কাহিনি আজ জনমানসে ধূসর, অবজ্ঞাত অজানিত।
অসমের ছোট জেলা কাছাড়। জেলা সদর শিলচর। কাছাড়ের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ছিল বাংলাভাষাকে অস্বীকার করে বাঙালিদের উপর বলপূর্বক অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার অপমানজনক নির্দেশ। ভৌগোলিক অবস্থান এবং সাংস্কৃতিক যোগসূত্রে কাছাড় ছিল বাঙালি প্রধান অঞ্চল। ১৮৩৮ খেকে ১৮৭৩ পর্যন্ত কাছাড়ে শিক্ষার মাধ্যম ছিল বাংলা।
১৯৬০ সালের এপ্রিলে অসম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দাবি তোলে। ওই বছরের ১০ অক্টোবর অসম বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা সর্ব স্তরে একমাত্র অসমিয়া ভাষা চালু করার উদ্দেশ্যে ভাষা বিল উত্থাপন করেন। ২৪ অক্টোবর পাশ হয় বিলটি। নিজেদের মাতৃভাষার অমর্যাদার প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে স্বাভিমানী বাঙালিজাতি। বরাক উপত্যকার তিনটি জেলা—কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির আশি শতাংশ বাংলাভাষি মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ১৯৬১ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি ভাষাবিলের প্রতিবাদে জনসম্মেলন হল করিমগঞ্জ রমণীমোহন ইনস্টিটিউটে। তৈরি হল গণসংগ্রাম পরিষদ। কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের নেতা রবীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেন বাংলাভাষাকে অসম সরকার স্বীকৃতি না দিলে ১৯শে মে সকাল থেকে সন্ধ্যা প্রর্যন্ত সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হবে।
১৯৬১ সালের ১৯মে ভোর থেকে শুরু হল পিকেটিং। শিলচর স্টেশন অবরোধ করল সত্যাগ্রহীরা। অসম রাইফেলস্, সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফোর্স, মাদ্রাজ রেজিমেন্টকে শান্তি রক্ষার জন্য নিয়োগ করেছিল অসম সরকার। বেলা দু’টো পর্যন্ত আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ভাবেই চলছিল। ইতিমধ্যে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহার সঙ্গে আলোচনার জন্য পৌঁছলেন গুয়াহাটি। আশ্চর্যজনক ভাবে এর অব্যবহিত পরেই হঠাৎ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের উপর নির্বিচারে নেমে এল অজস্র গুলির ধারা। সাত মিনিটে সতেরো রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল সৈন্যরা। বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার্থী ষোলো বছরের কমলা ভট্টাচার্য, উনিশ বছরের ছাত্র শচীন্দ্র পাল, কাঠমিস্ত্রি চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সদ্যবিবাহিত বীরেন্দ্র সূত্রধর, চায়ের দোকানের কর্মী কুমুদ দাস, বেসরকারি সংস্থার কর্মী সত্যেন্দ্র দেব, ব্যবসায়ী সুকোমল পুরকায়স্থ, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, রেলকর্মচারী কানাইলাল নিযোগী এবং আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে আসা হিতেশ বিশ্বাসের মত বহু মাতৃভাষা দরদী নিরীহ প্রাণ।
সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকার যে জন্মগত অধিকার, তা মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণার স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই ১৯৯৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বলে ঘোষণা করে। সর্বশেষে মণীশ ঘটকের কবিতার সূত্র ধরেই বলতে ইচ্ছা করে, ‘যে ভাষায় মাকে প্রথম ডেকেছি সে ভাষা আমার দেবতা।’
তথ্যসূত্র: ঝড় পত্রিকা
শিক্ষিকা, কান্দি রাজা এমসি গার্লস হাইস্কুল