চিরতরে হারিয়ে গিয়েছেন গুরপ্রীত সিংহ। ছবি:সংগৃহীত।
ক্ষমতা বা প্রভাব-প্রতিপত্তি কখনও একলা আসে না। সঙ্গে অনেকটা দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতা নিয়ে আসে। ক্ষমতা বা প্রতিপত্তির বহর যেমন, দায়বদ্ধতার বহরও তেমনই। গণতন্ত্রের পটভূমিকায় একজন সাধারণ নাগরিকের যেটুকু বা যতটা ক্ষমতা বা প্রতিপত্তি রয়েছে, সমাজের বা রাষ্ট্রের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতাও ততটাই। বিশিষ্ট বা বিশিষ্টতর নাগরিক হলে, দায়দায়িত্বের বহরও বিশেষ অবশ্যই। কিন্তু সে কথাটা অনেকেই মনে রাখতে পারেন না। বিশিষ্ট বা গণ্যমান্য হয়ে উঠতে পারলেই, প্রভাবে-যশে সাধারণের চেয়ে একটু উপরে উঠতে পারলেই, আশপাশটাকে একটু জোর করে ভেঙে-গড়ে নিজের পছন্দসই করে নেওয়ার চেষ্টাটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ভিতরে ভিতরে। রাষ্ট্রের প্রতি, সমাজের প্রতি, প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি দায়বদ্ধতার বোধটা তখন ফিকে হয়ে আসে। আর সেই শূন্যস্থানের দখল নেয় ক্ষমতা প্রদর্শনের অনৈতিক তাড়না।
আইনের প্রতি শ্রদ্ধাহীন এক আইনজীবীও সেই অনৈতিক তাড়নার শিকার হলেন, ফল ভুগতে হল গুরপ্রীত আর মনিন্দর নামে দুই ফুটফুটে তরুণকে। গুরপ্রীত চিরতরে হারিয়ে গিয়েছেন। মনিন্দর মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছেন হাসপাতালের শয্যায়। কারণ রোহিতকৃষ্ণ মহন্ত নামে এক আইনজীবী সম্প্রতি দুঃস্বপ্ন নামিয়েছিলেন দিল্লির ওই দুই তরুণের জীবনে।
আরও পড়ুন:ধূমপানে বারণ করায় যুবককে পিষে মারল আইনজীবী
প্রকাশ্যে ধূমপান করছিলেন রোহিতকৃষ্ণ, দুই তরুণের মুখের উপর ধোঁয়াও ছাড়ছিলেন। প্রতিবাদ করতেই গোলমাল শুরু। শেষে মত্ত আইনজীবীর গাড়ির ধাক্কা দুই তরণের বাইকে। ঘটনা পরম্পরা সম্পর্কে এ রকমই খবর পুলিশের কাছে। আইনজীবীর ‘অপরাধ’ প্রমাণ হবে কি না, নিজের প্রতিপত্তির জোরে রোহিতকৃষ্ণ ‘আইনের জাল’ কেটে ফেলতে সক্ষম হবেন কি না, সে প্রশ্ন পরের। সর্বাগ্রে প্রশ্ন জাগছে, বিশিষ্ট নাগরিকের নমুনা কি এমন হওয়া উচিত? আইনজীবী আইন ভাঙাকে অধিকার মনে করবেন, সাংসদ বিমানকর্মীকে জুতোপেটা করবেন বা ট্র্যাফিক পুলিশকে চড় মারবেন, মন্ত্রী ব্যাঙ্ককর্মীর গায়ে হাত তুলবেন, পুলিশকর্তা তোলা আদায় করবেন, অধ্যাপক ধর্ষণ করবেন— বিশিষ্টতার প্রমাণ কি বার বার আমরা এই ভাবে পাব?
সব বিশিষ্ট নাগরিকই এমন অশিষ্ট, সে কথা বলা যাবে না অবশ্যই। বিশিষ্টদের এই অশিষ্টাচারের নমুনা বিচ্ছিন্ন ভাবেই সামনে আসে বরং। কিন্তু বিচ্ছিন্ন হলেও ঘটনাগুলো বিরল নয় মোটেই, বার বার ঘটছে, ঘটনার সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। প্রবণতাটা যে ভাল নয়, তা স্বীকার করে নিতে দ্বিধা থাকা উচিত নয়। দায়বদ্ধতার পাঠটা আসলে সাধারণ নাগরিক জীবন থেকেই নেওয়া শুরু করতে হয়। নাগরিক হিসেবে সহ-নাগরিকের প্রতি, সমাজের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য কী, সর্বাগ্রে সেটুকুই বুঝে নিতে হয়। এর পর সাধারণ নাগরিক থেকে বিশেষ নাগরিক হয়ে উঠলে, বিশেষ দায়বদ্ধতার উপলব্ধিটা স্বকীয় ভাবেই অঙ্কুরিত হয়। যাঁদের মধ্যে সে অঙ্কুরোদগম সম্ভব হয় না, তাঁরাই বার বার নেতির কারণে শিরোনামে আসেন। ক্ষমতা বা প্রতিপত্তির অপপ্রয়োগে বিশেষত্বের প্রকাশ খোঁজেন এঁরা। এঁরা নামেই বিশিষ্ট, আসলে কিন্তু নন। বস্তুত শিষ্ট সাধারণ নাগরিক হওয়ার যোগ্যতাও নেই এঁদের।