কিশোর ডেভিডের গুলতিতে দানবাকার গলিয়থ-নিধনের কাহিনি আজও শ্রোতাদের পুলকিত করে। বৃহৎ বনাম ক্ষুদ্র, এই অসম যুদ্ধে পরাজয় ঘটিতে পারে বৃহতের, সেই সম্ভাবনা দুর্বলের মনে আশা না জাগাইয়া পারে না। ভারতের সাধারণ নির্বাচনে এই বৎসর তেমনই আশায় বুক বাঁধিয়াছেন কিছু প্রার্থী। বৃহৎ দলের বলশালী নেতাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে তাঁহারা গণ-তহবিলে চাঁদার আবেদন করিতেছেন। নির্বাচনী প্রচারে ব্যয় হইবে ওই টাকা। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা, বিহারের বেগুসরাই-এর সিপিআই প্রার্থী কানহাইয়া কুমার তাঁহাদের অন্যতম। আর্থিক সহায়তার আবেদন করিবার দুই দিনের মধ্যেই একত্রিশ লক্ষ টাকা জমা পড়িয়াছে তাঁহার প্রচার তহবিলে। আম আদমি পার্টি হইতে পূর্ব দিল্লির প্রার্থী আতিসি চল্লিশ লক্ষ টাকারও অধিক সংগ্রহ করিয়াছেন। ইতিপূর্বে বিধানসভা নির্বাচনে গুজারাতের দলিত নেতা জিগ্নেশ মেবাণীও প্রচারের অর্থের জন্য ‘ক্রাউডফান্ডিং’ বা গণ-তহবিলে চাঁদা সংগ্রহ করিয়াছিলেন। প্রবল-প্রতাপ ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে জয়ী হইয়া মেবাণী দরিদ্র-প্রান্তিক মানুষের আশা জাগাইয়াছেন। অর্থ সংগ্রহের এই নূতন পদ্ধতির পশ্চাতে রহিয়াছে নূতন প্রযুক্তি। কোচি হইতে কোচবিহার, যে কোনও এলাকার বাসিন্দা ঘরে বসিয়া দান করিতে পারেন পছন্দের প্রার্থীকে, কয়েকটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। দাতার পরিচয় গোপন করিবার উপায় নাই। আবার, কোনও প্রার্থীর গণ-তহবিলে সত্তর লক্ষ টাকা উঠিয়া গেলে আর চাঁদা জমা করিবে না ওয়েবসাইট। কারণ তাহাই নির্বাচনী প্রচারের নির্দিষ্ট ব্যয়সীমা। অতএব নৈতিকতার দিকটি সুরক্ষিত হইল।
অপর সুবিধাটি রাজনৈতিক— ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দশ টাকা, পঞ্চাশ টাকাও চাঁদা দিতে পারিবেন নাগরিক। ফলে বিপুল সংখ্যক ভারতীয়ের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের এক নূতন পথ খুলিয়া গেল। যাঁহারা দলীয় কর্মী নহেন, সেই নাগরিকদের এত দিন ভোটদান ভিন্ন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ লইবার কোনও উপায় ছিল না। এখন সমর্থন প্রদর্শনের অথবা প্রতিবাদ করিবার আরও একটি পথ তিনি পাইলেন। তাঁহার অপছন্দের নেতার প্রতিদ্বন্দ্বীকে দান করিয়া তাহার লড়িবার ক্ষমতা বাড়াইতে পারেন। আবার রাজ্য-নির্বিশেষে যে কোনও প্রার্থীকে দান করিয়া সদর্থক রাজনীতিকে সমর্থন জানাইতে পারেন। অপর পক্ষে, প্রার্থীও তাঁহার তহবিলের দাতার সংখ্যা এবং টাকার অঙ্ক দেখিয়া নিজের রাজনৈতিক শক্তির মূল্যায়ন করিতে পারিবেন। অতএব এমন গণ-তহবিল ক্ষুদ্রের সক্ষমতা বাড়াইয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সমতা আনিতে পারে। আজ অর্থ দিয়া ভোট কিনিবার খেলায় দেশবাসী বিরক্ত। বৃহৎ শিল্পপতিদের অর্থে বলীয়ান নেতারা সাধারণ নাগরিকের স্বার্থ উপেক্ষা করিতে পারেন, সেই আশঙ্কা অমূলক নহে। নির্বাচনী ব্যয়ে স্বচ্ছতা গণতন্ত্রে নূতন প্রাণ সঞ্চার করিতে পারে।
কেহ ভাবিতে পারেন, এত সামান্য অর্থে কি ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন সম্ভব? এই বৎসর সাধারণ নির্বাচনে আট হাজার কোটি টাকা ব্যয় হইবার সম্ভাবনা, তাহার কতটুকু আসিবে চাঁদা হইতে? উত্তর হইল, ইহা সূচনামাত্র। গণ-তহবিল রাজনীতিতে কত শক্তিশালী হইতে পারে, তাহার দৃষ্টান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থিপদ পাইবার প্রতিযোগিতা শুরু হইয়াছে। বার্নি স্যান্ডার্স গণ-তহবিলে চাঁদা আহ্বান করিবার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ছয় লক্ষ মার্কিন ডলার পাইয়াছেন। সেনেট-সদস্য এলিজ়াবেথ ওয়ারেন তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনিই গণ-তহবিল গড়িয়াছেন। ওয়ারেনের ঘোষণা, কর্পোরেট সংস্থা-সহ সকল বৃহৎ দাতাদের বর্জন করিয়াছেন তিনি। রাই কুড়াইয়া বেল করিবার মতো, ক্ষুদ্রের দান হইতে বৃহৎ বিকল্প নির্মাণ: ওয়ারেনের ব্রত। গণতন্ত্রেরও কি তাহাই উদ্দেশ্য নহে?