১৯৮৪ সাল। দীর্ঘ দু’দশক ধরে ব্রাজিলে চলা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দেশের নানা প্রান্তে তখন তীব্র অসন্তোষ। এমন সময়েই ‘ফেয়ার ইলেকশন নাও’ নামে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন দেশের সে সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় ফুটবলার। সরকার বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠল ব্রাজিলের জনপ্রিয় ক্লাব ‘কোরিন্থিয়ান্স’। অবশ্য তার আগে থেকেই এখানে তৈরি হয়েছিল সামরিক শাসনের প্রতিবাদী মঞ্চ ‘কোরিন্থিয়ান্স ডেমোক্র্যাসি মুভমেন্ট’। তার সঙ্গে ব্রাজিলের সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলারের নাম জুড়ে তৈরি হল ‘সক্রেটিস অ্যান্ড কোরিন্থিয়ান্স ডেমোক্র্যাসি’ নামে মঞ্চ। এই মঞ্চের সমর্থনে এগিয়ে আসা এক সাংবাদিক লিখলেন, ‘যদি এর পরেও দেশ থেকে সামরিক শাসনের উচ্ছেদ না হয়, তা হলে হয়তো সক্রেটিসদের মতো যাঁরা প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন তাঁদের অন্য দেশে চলে যেতে হবে।’ প্রতিবাদের আগুনে ঘি ঢালার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ সে দিন মাতৃভূমিকে বাঁচানোর সঙ্গে সঙ্গে শপথ নিয়েছিলেন প্রিয় তারকাকে দেশ থেকে চলে যেতে না দেয়ার।
জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। ফুটবল আজও তাকে মনে রেখেছে সর্বকালের অন্যতম সেরা ট্র্যাজিক নায়ক হিসেবে। পেলে ও মারাদোনা মধ্যবর্তী যুগের অন্যতম সেরা তারকা সক্রেটিস। তবে জন্মের বছরটাও বিশ্ব ফুটবলের হিসেবে ছিল অঘটনের বছর। সে বারই ‘ফেভারিট’ হাঙ্গেরিকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতেছিল ‘ব্ল্যাক হর্স’ জার্মানি। কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়ে ছিলেন পেলে পূর্ববর্তী সময়ের ‘ফুটবলের জাদুকর’ ফেরেঙ্ক পুসকাস। নিয়তি এক দিন এই একই পরিহাস করেছিল সক্রেটিসের সঙ্গেও।
১৯৮২ সাল। মাঠে ব্রাজিল নামলেই সাম্বার ছন্দে তাল মেলাচ্ছেন ভক্তেরা। দলে তারকার অভাব নেই। জিকো, ফ্যালকাও-সহ এক কথায় গোটা দলটাই যেন নক্ষত্রপুঞ্জ। ফুটবল তাঁদের প্রত্যেকের কাছে শুধু খেলা নয়, সাধনা। কিন্তু এত তারকার মাঝেও ভক্তদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে আট নম্বর জার্সিধারী ব্রাজিলের অধিনায়ক সক্রেটিস। প্রথম বিশ্বকাপ, তাতেই অধিনায়কের দায়িত্ব। গ্রুপ লিগের খেলাগুলি উতরে গেল সাম্বার ছন্দেই। মাঠের সঙ্গে সঙ্গে দল জিতে নিল ভক্তদের হৃদয়ও। সবার চোখের মণি সক্রেটিস। তাঁর পায়ে বল পড়লেই স্টেডিয়াম জুড়ে শিল্পকলা দেখার আগ্রহ। প্রায় ছ’ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চি উচ্চতা, মুখময় হাল্কা দাড়ি, মাথায় রিবন, কাঁধ পর্যন্ত কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল। সব মিলিয়ে সেই সময়ের ‘স্টাইল আইকন’ হয়ে উঠেছিলেন সক্রেটিস। কিন্তু এ বারেও ফুটবল দেবতার মনে ছিল অন্য কিছু। দ্বিতীয় রাউন্ডে ইটালির মুখোমুখি ব্রাজিল। ব্রাজিলীয় সৌন্দর্য থেমে গেল পাওলো রোসিদের অঙ্ক কষা ফুটবলের কছে। পুসকাসের মতোই কান্না নিয়ে মাঠ ছাড়লেন সক্রেটিস।
পেলে বা গ্যারিঞ্চার মতো অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে হয়নি ছেলেটিকে। ১৯৬০ সালে বাবা চাকরি পান শহরের রেভিনিউ সুপারভাইজ়ার পদে। ফলে, ছেলেবেলা থেকেই সরকারি কর্তার ছেলে বলে একটা বাড়তি সম্মান ছিলই। তার মধ্যেও হয়তো কোথাও ছিল নিজের পরিচয় তৈরির তাগিদ। পড়াশোনা চলতে থাকল। চিকিৎসক হলেন। পরিচয় তৈরির ভূতটা মাথায় থেকেই গিয়েছিল। সেটাই গিয়ে পড়ল খেলার মাঠে। ১৯৭৪ সাল থেকে শুরু হল ব্রাজিলের বিভিন্ন ফুটবল দলে খেলা। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭৪ সাল থেকে ‘বোতাফোগো এসপি’, ‘কোরিন্থিয়ান্স’, ‘ফিয়োরেন্তিনা’, ‘ফ্লামেঙ্গো’, ‘স্যান্টোস’-এর মতো ব্রাজিলের প্রথম সারির নানা দলের হয়ে ১৫৮ ম্যাচে খেলে ৭৬টি গোল করেন সক্রেটিস।
কোরিন্থিয়ান্সে খেলার সময়েই ডাক পড়ল জাতীয় দলে। ১৯৭৯ সাল। ব্রাজিলের জার্সি গায়ে মাঠে নামলেন সক্রেটিস। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৬, এই সাত বছরে ব্রাজিলের হয়ে ৬০টি ম্যাচে ২২টি গোল করেছিলেন এই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার। তবে শুধু সংখ্যাতত্ত্বে তাঁকে মাপতে গেলে অনেক কিছুই না বোঝা থেকে যাবে। ব্রাজিল দলে যোগ দেওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে দলের অধিনায়ক করা হল সক্রেটিসকে। চিকিৎসক হওয়ায় ফুটবল মহলে পরিচিত হলেন ‘ডক্টর সক্রেটিস’ নামে। ১৯৮২ সালে যখন অধিনায়কের রিবন পরে সক্রেটিস নামছেন তখন তাঁর নামের পাশে এক অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যান। তাঁর নেতৃত্বে ৩৫টি ম্যাচের মধ্যে ব্রাজিল ৩৩টিতে অপ্রতিরোধ্য। মাত্র দু’টি ম্যাচে হার। কিন্তু ১৯৮২ সাল বদলে দিল অনেক কিছুই। অধিনায়কত্ব ছাড়লেও, ফুটবল ভক্তদের তখনও তাঁর কাছ থেকে অনেক শিল্পকলা দেখা বাকি।
এসে গেল ১৯৮৬ সাল। ২৮ বছরের সেই তরুণ ৩২-এ পা দিয়েছেন। ফুটবল বিশ্বের অনেকেরই মনোযোগ তখন উদীয়মান তারকা আর্জেন্টিনার দিয়েগো মারাদোনায়। তবুও এই চিরতরুণ মাঠে নামলে সেই পরিচিত নাদে তখনও গর্জে উঠতেন ব্রাজিল ভক্তেরা। সে বার ‘রাউন্ড অফ সিক্সটিনে’ পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে না দৌড়েই পেনাল্টি কিক থেকে গোল করে শিরোনামে এসেছিলেন সক্রেটিস। নকআউট পর্যায়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধেও সেই একই ভাবে গোল করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। পরাজিত হয়ে প্রস্থান ঘটল ফুটবলের অন্যতম ট্র্যাজিক নায়কের।
১৯৬৪ সালের ১৫ মার্চ ব্রাজিলে উত্থান হয়েছিল সামরিক শাসনের। সেন্সরশিপের থাবা পড়েছিল বহু বইয়ে। নিষিদ্ধ হয়েছিল ‘মুক্তমনা’ বলে পরিচিত বহু লেখকের বই। সে দিন বাবাকে লাইব্রেরিতে বইগুলি জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে দেখেছিলেন সক্রেটিস। ঘটনাটা ভোলেননি। তাই সামরিক শাসনাধীন ব্রাজিলে বড় হলেও, প্রতি পদে সেই শাসনের সমালোচনা করা ছিল তাঁর অভ্যাস। ফুটবল ছাড়ার পরে কিছু দিন কাজ করেছিলেন জীবনের প্রথম ক্লাব বোতাফোগোর ম্যানেজার হিসেবে। তার পরে ফুটবল ছেড়ে পুরোপুরি লেখালেখির জগতে। ফুটবেলর পাশাপাশি, সমকালীন শাসনের কথা বারবার উঠে আসত তাঁর কলমে। ক্রমশ রাজনৈতিক দার্শনিকের পরিচিতিও পেলেন এই মানুষটি। তারই মাঝে ২০০৪ সাল নাগাদ ফিফা জীবিত সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে এক জন হিসেবে নির্বাচিত করল তাঁকে।
এর পর ২০১১ সাল। ২০১৪ সালে ব্রাজিলে বসবে ফুটবলের মহাযজ্ঞ। ১৯৮২ সালে এক বার লাতিন আমেরিকায় বিশ্বকাপ করার ভাবনা হয়েছিল। শেষে বেছে নেওয়া হয় স্পেনকে। দেশে ফুটবলের মহাযজ্ঞ দেখতে উদগ্রীব ছিলেন সক্রেটিস। অগস্ট থেকেই অবশ্য শরীর ভাল যাচ্ছিল না। পয়লা ডিসেম্বর প্রবল অসুস্থ হয়ে ভর্তি হন হাসপাতালে। অবশেষে ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর। মৃত্যু। অপূর্ণ রয়ে গেল নিজের দেশে ফুটবল বিশ্বকাপ দেখার স্বপ্ন।