ডিজিটাল হইয়াছে বিশ্ব। ক্ষুদ্র হইতে ক্ষুদ্রতর হইয়া দুনিয়া ধরা দিয়াছে কয়েক ইঞ্চির স্ক্রিনে। চিঠির আদানপ্রদান হইতে অর্থনৈতিক লেনদেন বা নিখাদ মনোরঞ্জন— সব কিছুরই দায়িত্ব লইয়াছে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেটরা। ক্রমে শৈশব গড়িবার দায়িত্বটিও তাহাদের হাতেই অর্পণ করিতেছে সমাজ। শিশুর চোখ ফুটিবার পর থেকেই সে গ্যাজেট-আসক্ত। এবিসিডি শিখিবার জন্যই হউক বা ভাত খাইবার ‘দুরূহ’ প্রক্রিয়াটি সহজ করিবার জন্যই হউক— গ্যাজেট বিনা গতি নাই। নিঃসন্দেহে স্মার্টফোন জীবনকে অনায়াস করিয়াছে। কিন্তু ইহাই কি মঙ্গলের পথ? ক্রমাগত ডিজিটাল-নির্ভরতার পরিণাম কী? কোনও আশাব্যঞ্জক কথা শোনাইতেছে না ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজ়েশন। এক নূতন উপদেশাবলিতে হু জানাইয়াছে, দুই থেকে চার বৎসরের শিশুদের কখনওই দিনে এক ঘণ্টার অধিক ডিজিটাল স্ক্রিনের সামনে রাখা চলিবে না। এবং আরও কমবয়সি শিশুদের, স্ক্রিন আছে এমন কোনও ধরনের বৈদ্যুতিন যন্ত্রের ধারেকাছে ঘেঁষিতে দেওয়াই উচিত নহে। গবেষণা বলিতেছে, বিশ্বে শিশুদের এক বড় অংশের হাতে কোনও না কোনও ভাবে স্মার্টফোনের মতো গ্যাজেট পৌঁছাইয়া যাইতেছে। এবং যে কোনও মানসিক সমস্যা হইতে পরিত্রাণ পাইতে সে সমাধানের পথে হাঁটিতেছে না, হাতের স্ক্রিনটিতে মনোনিবেশ করিতেছে। ফলে, শৈশব হইতে আবেগ বিদায় লইতেছে। মানসিক বিকাশের এই পর্বটিতে যাহা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। তদুপরি, স্ক্রিনের সামনে এক ভাবে দীর্ঘ ক্ষণ বসিয়া থাকিবার প্রবণতায় ওজনবৃদ্ধি, অনিদ্রার মতো একাধিক রোগেরও জন্ম হইতেছে।
সমস্যা গুরুতর। কিন্তু মানসিক বা শারীরিক সমস্যার ক্ষেত্রে স্মার্টফোনের ক্ষতিকর প্রভাব লইয়া তবু কিছু চর্চা হয়। যে প্রসঙ্গটি কালেভদ্রে আলোচনায় উঠিয়া আসে, তাহা হইল সমাজবিচ্ছিন্নতায় স্মার্টফোনের অবদান। এমনিতেই আধুনিক পৃথিবীতে শিশুরা বড় একা। যৌথ পরিবার ভাঙিয়া ক্ষুদ্র হইতে ক্ষুদ্রতর হইতেছে, মা-বাবা উভয়েই কর্মজীবনে ব্যস্ত। যে নিরাপদ পারিবারিক বেষ্টনীটি শিশুকে এত কাল ঘিরিয়া রাখিত, তাহা সরিয়া যাইতেছে। গ্যাজেটে মগ্ন শিশু আরও বেশি করিয়া সমাজ হইতে সরিয়া আসিয়া নিঃসঙ্গ হইতেছে। অর্থাৎ দুইটি কারণ পাশাপাশি একটি অন্যটিকে পুষ্ট করিতেছে। শিশু প্রয়োজনীয় সাহচর্য, চিত্তবিনোদন, শিক্ষা সব কিছুই স্ক্রিনে পাইয়া পারস্পরিক মেলামেশা ও আদানপ্রদানের তাগিদটি হারাইতেছে।
অন্য দিকে, বৌদ্ধিক বিকাশও নিদারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে। স্ক্রিনসর্বস্ব জীবনে সে নিজে কল্পনা করিবার সুযোগ পায় না। স্ক্রিনটিই নানা রঙিন মোড়কে তাহার কল্পনাটিকে বাস্তবে আনিয়া ফেলে। ফলে, স্ক্রিনে দেখা গল্পকে, ভাবনাকেই সে নিজস্ব কল্পনা বলিয়া ভাবিতে থাকে। কয়েক বৎসর পূর্বেও লালকমল-নীলকমল বা হিংসুটে দৈত্যের গল্প শুনিয়া সে নিজের মনে কতগুলি অবয়ব রচনা করিত। কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যমে সেই গল্পের ভিডিয়ো প্রদর্শন তাহার নিজস্ব কল্পনার জগৎটি চুরি করিয়া সেই স্থানে শিল্পীর ভাবনাকে বসাইয়া দিতেছে। ফলে, শিশুমন কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে তফাত হারাইয়া যন্ত্রে পরিণত হইতেছে। আগামী প্রজন্মের এক বৃহত্তর অংশ আবেগহীন যন্ত্রে পরিণত হইলে সমাজের পক্ষে কি তাহা স্বস্তির কারণ হইবে?