সাড়ে পাঁচশো বছর আগে যখন ছাপাখানা শুরু হল তখন অধ্যাপক ও ধর্মযাজক মার্টিন লুথার বলেছিলেন ছাপার অক্ষর পৃথিবীকে পাল্টে দেবে। দিলও তাই। লুথারের বাইবেলের অসংখ্য সংস্করণ বেরোল। গোঁড়া ক্যাথলিকদের বিপদ বাড়ল, আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের জন্ম হল। মোটের উপর, মানুষের ভাল বই মন্দ হল না।
১৪৮৭ সালে হাইনরিখ ক্রেমার নামে আর এক ধর্মযাজক একটি বই লিখলেন, ম্যালিয়াস ম্যালিফিকেরাম, ডাইনির হাতুড়ি। বইতে বলা হল, সাধারণ মানুষ কী ভাবে সহজে বুঝবেন কে ডাইনি আর কী ভাবেই বা চালাবেন ডাইনি খতম অভিযান। ষোড়শ শতক জুড়ে বই বিক্রির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ল ডাইনি খতম অভিযান। শতকের মাঝামাঝি পৌঁছে দেখা গেল, লুথারের বাইবেলকে কখনও ছাপিয়ে যাচ্ছে ম্যালিয়াস ম্যালিফিকেরাম–এর বিক্রি। সমকালীন ইতিহাসবিদ নিয়াল ফার্গুসন বলেছেন, ম্যালিয়াস ম্যালিফিকেরাম হল, বর্তমানের ফেক নিউজ়। ভাইরাল হওয়া ভুয়ো সংবাদ। ছাপার অক্ষর আসার ফলে সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি জনপ্রিয় হল হিংসার সমাজনীতিও।
একই ভাবে, সাড়ে পাঁচশো বছর পরে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা, আদর্শবাদী সব পিটিশনের পাশাপাশি হিংসা ও মেরুকরণের রাজনীতিকেও গ্রহণযোগ্য করছে ইন্টারনেট, সমাজমাধ্যম। হিংসার একটা বাজার ও স্থান বরাবরই ছিল ও আছে এই সমাজে।
ইতিমধ্যে মানুষ গণতন্ত্র ও গণতন্ত্র স্থাপনের লক্ষ্যে নির্বাচন আবিষ্কার করেছে। ইন্টারনেট এবং কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিষাক্ত তথ্যভান্ডার গণতন্ত্র ও নির্বাচনকে ধারাবাহিক ভাবে বিপর্যস্ত করছে। নির্বাচন ও সমাজব্যবস্থার উপরে এই আক্রমণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পত্রপত্রিকায় এখন নিয়মিত লেখা হচ্ছে “ভবিষ্যতে শেয়ার বাজারে ধস বা দাঙ্গা বা যুদ্ধের কারণ হতে পারে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তাদ্বারা নিয়ন্ত্রিত ফেক নিউজ়।” (ইকনমিস্ট, জানুয়ারি ২০১৮)।
নির্বাচনকে প্রভাবিত করার প্রক্রিয়া বছর পনেরো আগে শুরু হয়েছিল ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবং এটা শুরু হয়েছিল ওই গুটেনবার্গের ছাপাখানার যুক্তিতেই, জ্ঞান চর্চার কথা মাথায় রেখে। উদ্দেশ্য ছিল, ইন্টারনেট ও তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষের মনকে আরও বিশদে বোঝা। এক দিকে ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যম, ‘বিগ ডেটা’ ও অন্য দিকে মানুষের স্বভাব, মনন ও মনস্তত্ত্ব এই দুইয়ের একত্র চর্চা চলছিল। ব্রিটিশ ব্যবসায়ী আলেকজ়ান্ডার নিক্স বুঝলেন এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার সীমাহীন একটা বাজার রয়েছে। তৈরি করলেন একটি সংস্থা, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। স্বভাব ও মনস্তত্ত্ব অ্যালগোরিদমের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে রণকৌশল নির্ধারণ করা ছিল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ব্যবসা। কিন্তু বিজ্ঞাপন সংস্থার মতো পণ্য বেচত না তারা। নির্দিষ্ট দল, প্রার্থী বা মতবাদকে নির্বাচনে জেতানোর বরাত পেত। ব্রেক্সিট ও ট্রাম্পের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার কাজ করেছিল তারা।
গণতন্ত্র ও নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ভূমিকা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিচেল কোসিনাস্কি বলেছেন “ফেসবুকের লাইক, (গুগল) সার্চ, বিভিন্ন ওয়েবসাইট পরিভ্রমণ, ই-মেল বা ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার থেকে এক জন মানুষের স্বভাব, বুদ্ধি, যৌন প্রত্যাশা বা তিনি এর পরে কী কিনবেন বা কাকে ভোট দেবেন সেই সময়ে নির্দিষ্ট ভাবে বলে দেওয়া সম্ভব।” আলেকজ়ান্ডার নিক্স কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে এই কাজটাই করেছেন। তিনি ও তাঁর সংস্থা চিহ্নিত করেছেন নির্দিষ্ট ভোটার বা গোষ্ঠী কী ভাবে ভোট দেন। তার পর তাঁদের ভোটকে প্রভাবিত করেছেন। বস্তুত, নিক্স নিজেই বলেছেন, “লক্ষ লক্ষ ডেটা পয়েন্ট (যেমন ফেসবুক লাইক বা গুগল সার্চ) আমাদের কাছে রয়েছে, যা দিয়ে আমরা বুঝতে পারছি কোন বার্তা কাকে দিলে তা কী ভাবে কাজ করবে।” অর্থাৎ যে ভোটার বুঝতে পারছেন না, হিন্দুত্ববাদী দল না মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ সুরক্ষিত করবে এমন দল, কাকে ভোট দেবেন— তাঁকে যদি ক্রমাগত সামাজিক মাধ্যমে দেখানো যায় যে হিন্দুরা আক্রান্ত, তবে তিনি একটি দলের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়বেন।
প্রশ্ন হল, ওই নির্দিষ্ট ভোটারের ‘ডেটা পয়েন্ট’ বা ব্যক্তিগত তথ্য ব্রিটেন বা আমেরিকায় কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা পাবে কী ভাবে? সেটা না পেলে, অর্থাৎ আমি ফেসবুক, টুইটার, গুগল-এ কী করি, সেটা না জানলে আমি কোন দলকে ভোট দিই বা দিতে পারি, সেটা বোঝা যাবে না। এই তথ্য কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে দিয়েছিল ফেসবুক।
ফেসবুকের মালিক মার্ক জ়াকারবার্গ ২০১৮ সালে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে স্বীকারও করেছিলেন সে কথা। ও দেশে মানুষ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও তথ্যের সুরক্ষা নিয়ে বিস্তর মাথা ঘামান, ফলে নিক্স সাহেবের দোকান বন্ধ হয়ে গেল। জ়াকারবার্গ ক্ষমাটমা চেয়ে নিলেন। আমেরিকায় অবশ্য আলোচনাটা ২০২০-র নির্বাচনের আগে আবার ফিরে আসছে। ভোটাররা অতীব চিন্তিত।
ভারতে অবশ্য মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার বা তার সুরক্ষা কার্যত বিশেষ কিছু নেই। ফলে চিন্তাও কম। মানুষ যেখানে খেতে পান না, বা পেলেও সারা দিন নানান অনিশ্চয়তায় ভোগেন, সেখানে ব্যক্তিগত তথ্যের সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামাতে বিশেষ কেউই আগ্রহী নন। নির্বাচনের ভাষায়, এটা কোনও বিষয়ই নয়। এখানে মানুষ ডেটা চুরি নয়, চাল চুরি নিয়ে স্বাভাবিক কারণেই অনেক বেশি চিন্তিত। যদিও সম্প্রতি তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন কতকটা এই বিষয় নিয়ে সংসদে বিবৃতি দিয়েছেন। বলেছেন, ফেসবুক ভারতে নির্দিষ্ট দলের হয়ে কাজ করছে। ভারতে অবশ্য এটা নির্দিষ্ট ভাবে প্রমাণ করা মুশকিল। এখানে আমেরিকার মতো নজরদারির ব্যবস্থা নেই। ভারতে ‘হুইসল-ব্লোয়ার’ অর্থাৎ যিনি নিজের সংস্থার মালিকের নামে বিবৃতি দেবেন, তার সংস্কৃতিও নেই। সবচেয়ে বড় কথা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ মিথ্যে কথা বিশ্বাস করতে পছন্দ করেন, যদি সেটা পছন্দের মিথ্যে হয়।
এমতাবস্থায় ডেটা চুরি হবে ও হচ্ছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল যে হারে ডেটা বিশ্লেষক বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কর্মরত গবেষকদের পুষছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে ভোটারদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও তার বিশ্লেষণের গণতান্ত্রিক বাজার ভারতে ক্রমশই স্ফীত হচ্ছে। যদিও এখানকার আলেকজ়ান্ডার নিক্স বা স্টিভ ব্যাননদের (এই ভদ্রলোক একাধারে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কর্ণধার ও ট্রাম্পের উপদেষ্টা ছিলেন) সম্পর্কে এখনই বিশেষ কিছু জানা যাচ্ছে না। সারা ক্ষণ স্বচ্ছতার কথা বলার পাশাপাশি ভারতের নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ফেসবুকের কাজকর্ম নিয়ে সবেমাত্র কিছু গবেষক ও সাংবাদিক আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন, এই পর্যন্ত।
ইতিমধ্যে আবার এক নতুন বিতর্ক। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ায় ফেসবুকের প্রধান নীতিনির্ধারক আঁখি দাস ভারতীয় জনতা পার্টির এক নেতার ‘বিদ্বেষমূলক ভাষণের বিরুদ্ধে’ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে ‘শিথিলতা’ দেখিয়েছেন বলে অভিযোগ। তিনি এ কাজ করেছেন তাঁর সংস্থার মুনাফা বাড়ানোর লক্ষ্যে, এমনটাই বলা হচ্ছে। ফেসবুক-ঘরানার সংস্থার ব্যবসা বা মুনাফা বাড়ানোর চরিত্রটা আলাদা। এঁরা মানুষের মন পরিবর্তনের মাধ্যমে কোনও দলকে জেতানোর চেষ্টা করছেন, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। এই কাজটাই সংবাদপত্র করলে, একাধিক মামলা হত। কিন্তু ফেসবুকের বিরুদ্ধে হবে না তিনটে কারণে। এক, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফেসবুক নিয়ন্ত্রণের নির্দিষ্ট আইন সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের ধারণা নেই। বস্তুত, আইনই নেই। দুই, আইন করার ব্যাপারে সবাই গড়িমসি করবেন, কারণ নির্বাচন জিততে সবারই ফেসবুককে প্রয়োজন। তিন, ফেসবুকের বাজারমূল্য অনেক রাষ্ট্রের জিডিপির থেকেই বেশি। এখন তা ৮০ লক্ষ কোটি, যা অচিরেই ১০০ লক্ষ কোটি হবে। এই কারণে ফেসবুককে ‘সুপারপাওয়ার নেশন’ বলা হচ্ছে। এই ‘নেশন’ অন্য যে কোনও নেশনের গণতন্ত্রের চোদ্দোটা বাজিয়ে দিতে পারে, ঠিকঠাক বেতন পেলে।
এই অবস্থায় স্বাভাবিক প্রশ্ন, ছোটবেলায় শোনা ‘আমার ভোট গোপন ভোট’ এই কথার কি আজ আর কোনও মানে আছে? খরচপাতি করলে সবই তো জানা যায়! ছোট দল জানতে পারবে না, কিন্তু বড় দল চাইলেই জানতে পারবে কে কোথায় ভোট দিচ্ছেন । এই পরিস্থিতিতে ভোটের নিয়মনীতির কি পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন? কে ভাববে সে সব কথা?