বিপ্লবের পঁচিশ বছর
Mobile Revolution in India

মোবাইল ফোন আমাদের জীবনযাত্রার খোলনলচে বদলে দিয়েছে

ভারতীয় সমাজে মোবাইল অনুপ্রবেশের গভীরতা সুস্পষ্ট। এখন কনিষ্ঠতম কেরানি থেকে বরিষ্ঠতম আমলা, সকলের জীবনই মোবাইল ছাড়া অচল। পরিসংখ্যানও একই কথা বলছে।

Advertisement

অভিরূপ সরকার

শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২০ ০০:০৩
Share:

ভারতে মোবাইল বিপ্লবের পঁচিশ বছর পূর্ণ হল। ১৯৯৫ সালের ৩১ জুলাই, ভারতে মোবাইল ফোন সংযোগের উদ্বোধন করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। দিল্লির সঞ্চার ভবনে ভারতের টেলিকম মন্ত্রী সুখরামকে তিনি কলকাতা থেকে প্রথম কলটি করেন। তার মোবাইল পরিষেবা এসেছিল ‘মোদী-টেলস্ট্রা’ নামক সংস্থার কাছ থেকে। তার পর দেখতে দেখতে পঁচিশ বছর। মোবাইল পরিষেবা এবং মোবাইল সেটের প্রযুক্তি, দুইয়েরই খোলনলচে বদলে গেছে। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, এই সিকি শতাব্দীব্যাপী সময়ে যে মোবাইল সংস্কৃতি ভারতীয় জনজীবনের হাড়ে-মজ্জায় পাকাপাকি ঢুকে গেছে, তার আর্থসামাজিক তাৎপর্য অপরিসীম।

Advertisement

ভারতীয় সমাজে মোবাইল অনুপ্রবেশের গভীরতা সুস্পষ্ট। এখন কনিষ্ঠতম কেরানি থেকে বরিষ্ঠতম আমলা, সকলের জীবনই মোবাইল ছাড়া অচল। পরিসংখ্যানও একই কথা বলছে। টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অব ইন্ডিয়া বা ট্রাই-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ ডিসেম্বরে দেশে মোট মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ১১৫ কোটির কিছু বেশি। বর্তমানে আমাদের জনসংখ্যা ১৩৮ কোটি, তার প্রায় ৪০ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের কম, যারা নিজেদের নামে সিম কার্ড কেনার বয়সগত যোগ্যতা এখনও অর্জন করতে পারেনি। এই সংখ্যাটা মোট জনসংখ্যা থেকে বাদ দিলে প্রাপ্তবয়স্কদের যে সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে, সেটা মোবাইলের মোট গ্রাহকসংখ্যার থেকে অনেকটাই কম। অর্থাৎ ভারতে এখন প্রাপ্তবয়স্কদের মাথাপিছু একের বেশি সিম কার্ড।

এটা অবশ্য গড় হিসেব। এর মানে এই নয় যে, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয় নাগরিকের অন্তত একটি মোবাইল কানেকশন আছে। বাস্তব হল, কিছু ভারতীয় যেমন একাধিক মোবাইল পরিষেবার গ্রাহক, তেমনই এখনও এমন অনেক ভারতীয় নাগরিক আছেন, যাঁদের কোনও মোবাইলই নেই। ট্রাই জানাচ্ছে, গ্রামে মোবাইল পরিষেবার মোট গ্রাহক সংখ্যা ৫০.৭ কোটি, শহরে ৬৪.৪ কোটি— যদিও শহরের তুলনায় গ্রামে অনেক বেশি মানুষের বসবাস। ট্রাই-এর দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, গ্রামে মোবাইল পরিষেবার গ্রাহক সংখ্যা প্রতি ১০০ জনে ৫৬.৬৭টি, শহরে গ্রাহক সংখ্যা ১০০ জন প্রতি ১৫৬.২৬। অর্থাৎ শহুরে মানুষের মাথাপিছু দেড়খানা সিম কার্ড, গ্রামে দু’জন মানুষ প্রতি একটা। ভারতে মোবাইল পরিষেবা, সর্বত্রগামী না হতে পারলেও, বহু বিচিত্র ও দুর্গম স্থানে পৌঁছতে পেরেছে।

Advertisement

বিমান, মোটরগাড়ি, টেলিফোন, টেলিভিশন, কম্পিউটার এবং অবশ্যই মোবাইল ফোনের মতো যে সব অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার গত এক-দেড়শো বছরে মানুষের জীবনযাপনকে আমূল বদলে দিয়েছে, তাদের একটা সাধারণ ধর্ম আছে। একটি আবিষ্কারের ফলে যখন নতুন কোনও পণ্য প্রথম বাজারে আসে, তখন অবধারিত ভাবে তার দাম থাকে চড়া। অত্যন্ত অবস্থাপন্নরাই তখন সেই পণ্যটি কিনতে পারেন। তার পর এক দিকে ধারাবাহিক গবেষণার ফলে পণ্যটির উৎপাদন খরচ ক্রমশ কমে আসে, এবং অন্য দিকে প্রতিযোগীরাও অনুরূপ পণ্য নিয়ে আসে বাজারে, যা বহু ক্ষেত্রে উন্নততর। সব মিলিয়ে আস্তে আস্তে পণ্যটির বিক্রয়মূল্য কমতে থাকে এবং পণ্যটি উচ্চবিত্ত ছাড়াও মধ্যবিত্তদের আয়ত্তে চলে আসে।

কিন্তু গবেষণা ও প্রতিযোগিতার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সেই কারণে পণ্যটির দাম আগের থেকে কমলেও, একটা জায়গায় গিয়ে আটকে যায়, আর কমতে পারে না। ফলে নীচের তলার মানুষদের কাছে পণ্যটি অধরাই থেকে যায়, বিশেষত আমাদের মতো দেশে, যেখানে সমাজের নিচুতলার মানুষদের আয় খুবই অল্প, এবং সেই জনগোষ্ঠী আয়তনে বিপুল।

এখানেই কিন্তু আধুনিক নগরজীবনের অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে মোবাইল ফোনের তফাত। গাড়ি, কম্পিউটার, বিমানভ্রমণ ইত্যাদি বেশির ভাগ নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যই যেখানে মধ্যবিত্তদের গণ্ডিতে আটকে গেছে, নিম্নতর বিত্তের মানুষদের কাছে পৌঁছতে পারেনি, সেখানে মোবাইল ফোন ও তার পরিষেবা অনেক নীচ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পেরেছে। একে অনায়াসে একটা বিপ্লব বলা যেতে পারে।

মোবাইল পরিষেবা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে দেশে ইন্টারনেটের ব্যবহারও বিস্তর বেড়েছে। ট্রাই-এর তথ্য অনুযায়ী প্রতি ১০০ জন ভারতীয়ের মধ্যে ৫৪.২৯ জন ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এটা ডিসেম্বর, ২০১৯-এর পরিসংখ্যান। ট্রাই এটাও জানাচ্ছে যে, ইন্টারনেট গ্রাহকদের ৯৬.৮ শতাংশই ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। অর্থাৎ মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট পরস্পরের পরিপূরক। স্মার্টফোন থাকলে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ে, আবার বহু ক্ষেত্রে ইন্টারনেট নাগালে পেতেই স্মার্টফোনের চাহিদা। মোবাইল ফোন ভারতবাসীকে দিয়েছিল উন্নততর যোগাযোগ ব্যবস্থা, যার সামাজিক এবং অর্থনৈতিক মূল্য কম নয়। কিন্তু এর সঙ্গে ইন্টারনেট যুক্ত হওয়ায় সারা পৃথিবীর তথ্য আক্ষরিক অর্থে হাতের মুঠোয় চলে এল। এখন কাজকর্ম, পড়াশোনা, আমোদপ্রমোদ সব কিছুর জন্যেই ভরসা সেই মুঠোয় ধরা মোবাইল ফোন।

যুগ্ম ভাবে মোবাইল এবং ইন্টারনেট থেকে পাওয়া উপযোগিতার তালিকাটি দীর্ঘ। সরকারি-বেসরকারি-ব্যক্তিগত ইমেল বা টেক্সট মেসেজই হোক কিংবা রান্নার গ্যাসের জন্য সিলিন্ডারের বায়না করা, মিস্ত্রি ডাকা, খাবার আনানো, আবার বহু বছর পরে পুরনো বন্ধুর সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ, দূরদেশে প্রিয়জনের সঙ্গে ভিডিয়ো চ্যাট, সবই তো মোবাইলের মাধ্যমে। সরকারি সুযোগসুবিধা বিতরণের কাজে মোবাইলের ভূমিকা বাড়ছে, ব্যাঙ্কে টাকা লেনদেনেও। গ্রামোফোন, সিনেমা হল থেকে ভিডিয়ো গেম পার্লার, মুঠোয় ধরা আয়তক্ষেত্রাকার যন্ত্রটি আপনি যা চাইবেন, তা-ই। এমন বহুরূপী, বহুগুণসম্পন্ন বন্ধু আর কে আছে? বিশেষ করে এই লকডাউনের ঋতুতে?

তবু সবটাই যে উপকার, তা নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় সুতথ্য যেমন আসে তেমনই কুতথ্যও কম আসে না। ভুল তথ্যের প্রসারণ কখনও অনিচ্ছাকৃত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ইন্টারনেট-সোশ্যাল মিডিয়ার অসীম ক্ষমতা। বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের ওপর অত্যাচারের ভুয়ো ছবি দেখিয়ে দাঙ্গা বাধিয়ে দেওয়া যায়; পরিকল্পিত ভাবে ভুল খবর ছড়িয়ে নির্দোষকে দোষী বানিয়ে দেওয়া যায়; ডাক্তাররা বলছেন, এমন ভাবে উপস্থাপন করে বিষকে অমৃত করে তোলা যায়। যা কিছু ছাপার অক্ষরে ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যায়, কিছু সরল-বিশ্বাসী মানুষ সেটা বিশ্বাস করেন। বিশেষ করে আমাদের দেশে, যেখানে ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয়েছে, ছাপার অক্ষরে যা কিছু আছে তাকে প্রশ্ন না করে মেনে নিতে। প্রশ্ন ওঠে, যে সমাজ ঠিক-ভুলের বিচার করতে পারে না, সে কি মোবাইল-বাহিত বিপুল তথ্য গ্রহণ করার উপযুক্ত?

কোনও কোনও বিজ্ঞানীর মতে, সেলফোন এবং তার টাওয়ার থেকে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ নিয়ে চূড়ান্ত কিছু জানা যায়নি, তাই অ্যামেরিকান ক্যানসার সোসাইটি কিংবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে জোর দিয়ে কিছু বলতে এখনও নারাজ। কিন্তু সমস্যা যে একটা আছে, সেটা অনেকেই স্বীকার করেছেন। আসলে মোবাইল ফোনের পিছনে যে বিপুল ব্যবসায়িক স্বার্থ আছে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করে সত্যটা প্রকাশ করা সহজ কাজ নয়। এ রকম একটা লড়াই এক সময় ধূমপানের বিরুদ্ধেও হয়েছিল। সেই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত যখন তামাক বিক্রেতারা কিছুটা পিছু হটতে বাধ্য হল, তত দিনে বহু মানুষের ক্যানসারে মৃত্যু হয়েছে।

আর একটা কথা। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ স্থাপনের জন্য যে মোবাইল ফোন, সেটাই কি একটা মানুষকে আর একটা মানুষের থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে না? সেই সাবেক পাড়ার আড্ডা, চায়ের দোকানের জমায়েতের বদলে এখন সকলেই নিজের নিজের মোবাইলে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে। বোধ করি, এই নাগরিক দূরত্বই প্রগতির নিয়ম।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement