শরিয়ত বয়াতির মুক্তির দাবিতে ঢাকায় বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি
আবারও এক সুফি বাউলের প্রতি অনাচারের অভিযোগ তুলিলেন বাংলাদেশের মুক্তমনারা। এক মাদ্রাসা শিক্ষকের অভিযোগের ভিত্তিতে শরিয়ত বয়াতি নামক সুফি বাউল শিল্পীকে পুলিশ কেবল গ্রেফতারই করে নাই, ধর্মদ্রোহের মামলা দিয়া হেফাজতে লইয়াছে। ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন নহে, বরং শেখ হাসিনার দেশে মৌলবাদীদের হস্তে সুফি বাউলদের লাঞ্ছিত হইবার সংবাদ দৈনন্দিনতায় পর্যবসিত। সরকারের নিকট মুক্তমনাদের দাবি— ধর্মদ্রোহের মামলা প্রত্যাহার করিয়া মুক্তি দিতে হইবে বয়াতিকে। তাঁহার অপরাধ, এক অনুষ্ঠানে তিনি ঘোষণা করিয়াছিলেন, ইসলামে গান-বাজনা নিষিদ্ধ এই কথা যদি কেহ প্রমাণ করিতে পারেন, তাঁহাকে পঞ্চাশ সহস্র টাকা অর্থমূল্যে পুরস্কৃত করিবেন। ইহার সহিত ‘টুপিধারী হুজুর’দের অপব্যাখ্যার বাগাড়ম্বরকেও কটাক্ষে বিদ্ধ করেন বয়াতি। ঐকমত্যে না পৌঁছাইবার অধিকার সকলের আছে, কিন্তু তাহা বলিয়া গ্রেফতারের দাবি? কিংবা থানায় অভিযোগ? সর্বোপরি, তাহা কার্যকর হওয়া?
প্রসঙ্গত প্রথমেই স্পষ্ট করা ভাল, প্রশ্নটি উঠিতেছে ধর্মীয় মৌলবাদ রুখিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের ভূমিকা প্রশংসার্হ বলিয়াই। তাঁহার আমলে বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামি মৌলবাদী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ ঘোষিত হইয়াছে। কিন্তু জামাতকে ঠেকাইবার উদ্দেশ্যে সরকার অপর এক শ্রেণির মৌলবাদীর নিকট নতমস্তক হইতেছে বলিয়া অভিযোগ করিতেছেন মুক্তমনারা। অভিযোগের সারবত্তা নাই, এমন নহে। জামাতকে নিষিদ্ধ করিবার পরেও কিছু কিছু এলাকায় নির্যাতন চলিয়াছে— উদ্ধৃত ঘটনাই প্রমাণ যে কেবল অপর ধর্মের মতাবলম্বীরা নহেন, ইসলামের ভিতরেও যাঁহারা অপর ধারায় বিশ্বাসী, তাঁহারাও বিপন্ন হইয়াছেন। আক্রমণের শিকার হইয়াছেন মুক্তমনারাও। সেই সূত্র ধরিয়াই উদারমনস্ক ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করিতেছেন। এই সমালোচনাকে যথাযোগ্য গুরুত্ব না দিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এত দিনের বহুকষ্টকৃত কাজ সাফল্যে পৌঁছাইবে না।
ঘটনা হইল, মধ্যপন্থীদের এই আদর্শ-চ্যুতি কোনও একটি দেশের, বা কোনও বিশেষ সরকারের সঙ্কট নহে। ইহা একটি সর্বকালীন সঙ্কট। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, এমনকি ভারতও মধ্যপন্থীদের এই চ্যুতির পথে হাঁটিয়াছে। ক্ষমতায় থাকিবার ফলে, বিবিধ পক্ষের মধ্যে সমঞ্জসতা রক্ষা করিবার চাপেই বহু ক্ষেত্রে অন্যায়ের সহিত আপস করিবার প্রবৃত্তি তৈয়ারি হয়। এবং তাহা ক্ষমতাসীনের পক্ষেই সর্বাধিক মারাত্মক হইয়া দেখা দেয়, কেননা, এই চ্যুতির পথ ধরিয়া পুষ্টিলাভ করে উগ্রপন্থী শক্তি। আপনাদের ঘৃণার রাজনীতি ব্যতিরেকে দেশে দেশে যে রাজনৈতিক বাহনে ভর দিয়া ক্ষমতার পথে আগাইতে থাকে দক্ষিণপন্থীরা, তাহার রূপ ইহাই। অতএব সময় থাকিতে পৃথিবীর নানা দেশের পরিস্থিতি হইতে শিক্ষা লইয়া আপন দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক মেরামতির সূচনা করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট হইতে প্রত্যাশিত। যে বিপুল সংখ্যক মানুষের আস্থা জিতিয়া তিনি ক্ষমতায় পুনরভিষিক্ত হইয়াছেন, উদারমনস্কদের ন্যায্য সমালোচনার পরিসরটি বাড়িতে দিলে কিন্তু সেই মানুষের আস্থার প্রতিই অন্যায় করা হইবে।