ছবি রয়টার্স।
এ বার অস্ট্রিয়া, ফ্রান্সের পর। রাজধানী ভিয়েনার জনবহুল অঞ্চলে যে মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়া গেল, তাহার সহিত ইসলামি সন্ত্রাসবাদের সংযোগ স্পষ্ট, আইএস-এর প্রতি আততায়ীর বিশ্বস্ততা ইতিমধ্যে প্রমাণিত। এখনও ফ্রান্সের ঘা শুকায় নাই, তাহার মধ্যেই আর একটি এমন ঘটনায় শিহরিত হইয়া উঠিতেছে সভ্য দুনিয়া। ফরাসি স্কুলশিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটিকে হত্যা সংশয়াতীত ভাবেই সাম্প্রতিক কালের অন্যতম নিকৃষ্ট অপরাধের তালিকায়। সম্পূর্ণ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য চরমপন্থী গোষ্ঠী কী রূপে বিশ্বব্যাপী বিপদ ডাকিয়া আনিতে পারে, তাহার উদাহরণ এই সব নারকীয় হত্যাকাণ্ড। যে সকল ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এই ন্যক্কারজনক কার্যকলাপের জন্য দায়ী, তাহাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়িয়া তোলা এখন কেবল ফ্রান্স বা অস্ট্রিয়ার দুশ্চিন্তা নহে, সমগ্র সভ্য দুনিয়ার কর্তব্য। ইসলামি সন্ত্রাসবাদের প্রবল পরাক্রম যেন আবার নূতন করিয়া আত্মপ্রকাশ করিতেছে, আইএস-এর মতো নৃশংস গোষ্ঠী আবার নূতন করিয়া বিশ্বমঞ্চে অবতীর্ণ হইয়াছে।
সংশ্লিষ্ট অপরাধীগণ যেহেতু নিজেদের ধর্মপরিচয় জাহির করিয়াই এই সকল ভয়ঙ্কর দুষ্কর্ম করিতেছে, ইসলামি চরমপন্থাকে ধিক্কার জানানো প্রথম কর্তব্য। তবে যে কোনও দুষ্কর্মের ক্ষেত্রেই প্রকৃত দায় দুষ্কর্মকারীদের, তাহাদের সমাজের নহে। তাই এই কাজের জন্য যাঁহারা সমগ্র ইসলামি দুনিয়াকে দায়ী করিতেছেন, তাঁহারা ভুল করিতেছেন। আজ ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ায় মুসলিম জনগোষ্ঠীও আবার নূতন করিয়া বিদ্বেষ ও আক্রমণের মুখে পড়িতেছেন, যাহা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। কোনও সভ্য ও যুক্তিবাদী ব্যবস্থায় কখনওই কিয়দংশের কর্মকাণ্ডের দায় সকলের স্কন্ধে ন্যস্ত করা চলিতে পারে না। এই প্রসঙ্গে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ-র বিতর্কিত মন্তব্যটি বিচার্য। তাঁহার কড়া মন্তব্যটিকে প্রসঙ্গচ্যুত করিয়া অনেকেই তাঁহাকে ‘ইসলামবিরোধী’ তকমা দিতেছেন। বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, প্রজাতন্ত্রের মূল্যবোধকে তুলিয়া ধরা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার পক্ষে বলিতে গিয়া ইসলামের উল্লেখ করিয়াছিলেন মাকরঁ: ইসলামের বিশ্বজনীন সঙ্কটটিই চিহ্নিত করা ছিল তাঁহার অভিপ্রায়। বাস্তবিক, ফ্রান্সের সমাজে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা কেবল সংখ্যায় বৃহৎ নহেন, বহু দিন ধরিয়া ফরাসি সমাজে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট দেশের ভিতরকার এই গোটা জনগোষ্ঠীকে অপরাধী ঠাহরাইতে পারেন না। বস্তুত মাকরঁ ইতিপূর্বে বারংবার ফ্রান্সের ঐক্য ও সামাজিক সংহতির পক্ষে সরব হইয়াছেন। উক্ত বক্তৃতাতেও তিনি ফরাসি মুসলমানদের কলঙ্কিত করিবার ফাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলিয়াছেন। সুতরাং বৃহত্তর ইসলামি বিশ্ব এখন ইসলামের নামে ন্যক্কারজনক জঙ্গিপনার কঠোর সমালোচনা না করিয়া যে ভাবে মাকরঁ-র নিন্দায় মুখর হইতেছে, তাহা অত্যন্ত অসঙ্গত, আপত্তিকর— গভীর দুর্ভাগ্যের দ্যোতক।
তবে এই সম্ভাবনাটি মাথায় রাখিয়া রাষ্ট্রনেতা হিসাবে মাকরঁ-রও আরও সতর্ক মন্তব্য বাঞ্ছনীয় ছিল। উদ্দেশ্য ন্যায্য হইলেও কোন কথা কোন ভাবে বলিলে লাভের অধিক ক্ষতি, এই জটিল পরিস্থিতিতে তাহা খেয়াল না করিলে চলিবে কেন। ভাবের ঘরে চুরি করিয়া লাভ নাই, ‘ইসলামি সন্ত্রাস’ শব্দবন্ধটি মাকরঁ-র মতো নেতারা আবিষ্কার করেন নাই, সন্ত্রাসবাদীরা নিজেরাই নিজেদের ইসলামি বলিয়া গৌরব প্রকাশ করিয়াছে। লিবারালদের কাজ তাই এখন দ্বিগুণ কঠিন। তাঁহাদের এই ইসলামি সন্ত্রাসের মোকাবিলা করিতে হইবে, তৎসঙ্গে বাকি ইসলামি সমাজকে প্রাপ্য সম্মান ও নিরাপত্তা প্রদান করিতে হইবে। বিপরীতে, ইসলামি দুনিয়ারও কিছু কর্তব্য থাকিল বইকি। প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক উদ্যোগে তাঁহাদের মুক্ত কণ্ঠে এই নৃশংস অনাচারের বিরুদ্ধতা করা জরুরি। নতুবা এক পা-ও অগ্রসর হওয়া যাইবে না।