অশান্তির চক্রব্যূহে আজাদি খুঁজছে শাহিনবাগ

বিবিধের মাঝে মিলন মহানের স্বপ্ন বুনবে আশিয়ানারাই। দাদিদের শপথের হাতগুলো যে ভীষণ দৃঢ! ওঁদের মন ও মান রাখতেই যেন আশিয়ানার শীতসফর। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলাম

Advertisement

জিনাত রেহেনা ইসলাম

শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২০ ০২:২১
Share:

এই মুহূর্তে শাহিনবাগ এক পুণ্যভূমির নাম। মাটি ছুঁয়ে দেখতে চায় মন। সাহসের মুখে শৈত্যপ্রবাহও যেন দ্রোহের আগুন! আদর নুরুন্নেসা ও বিলকিস এবং আসমা দাদি-সহ সব প্রতিবাদীদের। মা রেহানার কোলে আশিয়ানা ২৩ দিনেই অভিমন্যু। অশান্তির চক্রব্যূহে দাদিদের সঙ্গে আজাদির ঠিকানা খুঁজছে সে-ও। আগামীতে বিবিধের মাঝে মিলন মহানের স্বপ্ন বুনবে আশিয়ানারাই। দাদিদের শপথের হাতগুলো যে ভীষণ দৃঢ! ওঁদের মন ও মান রাখতেই যেন মায়ের কোলে আশিয়ানার শীতসফর। বাচ্চাগুলোর পায়ের তলায় দেশের শক্ত মাটির প্রতিশ্রুতি আদায়ে বদ্ধপরিকর দাদিরা। উচ্চকণ্ঠ দাদিদের। তাঁদের ভয় নেই বরং বুকভরা সাহস আছে। অত্যাচার চলছে নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের প্রতিবাদীদের উপরে। তাতে কী! দাদিদের মধ্যে অনেকের নেই নাগরিকের হক-প্রমাণের কাগজও। তাই সরকার বাহাদুরের কানে আওয়াজ তুলতে পথে নামা।

Advertisement

মা রেহানাও জানেন, কতটা পথ পেরিয়ে এলে সত্যিকারের পথে নামা সম্ভব হয়। নতুন এই আইন এক অস্থিরতা এনে দিয়েছে সংসারে। মানুষের মনে জটিলতা বাসা বাঁধছে। রাতের ঘুম ছুটেছে। দলীয় আদর্শ ও সরকারের কাজের রূপরেখা কোথাও মিলে যাচ্ছে। এই ভয় মানুষকে দিনে দিনে গ্রাস করেছে। গণতন্ত্রের সামনে এ এক অন্য বিপদ। তাই আজ মানুষের সামনে দু’টি রাস্তা। একপক্ষ, না হলে বিপক্ষ। মুসলিম ও অন্য ক্ষমতার আড়ালে পড়ে থাকা মানুষের সামনেও দু’টি রাস্তা। প্রতিবাদ করা। না হলে বিলীন হয়ে যাওয়া। প্রতিরোধের সামনে এক বার মাথা উঁচু করে মত প্রকাশ করা। নির্বিবাদী সহনশীলতার বিরুদ্ধে অপছন্দের অধিকারকে সামনের সারিতে বসিয়ে যাওয়া।

দেশজুড়ে মেয়েরা জেলবন্দি হয়েছেন। প্রতিবাদ সমাবেশে হেনস্থা হয়েছেন। লাঠি খেয়েছেন। জেলেও মার খাচ্ছেন, এমন অভিযোগও আসছে বার বার। স্বামীর মারে চুপ থাকা মেয়ে যিনি কখনও পুলিশের কাছে নালিশ করেননি তিনিও রাস্তায় নেমেছেন। নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই দেশে এক হাত মাটি বরাদ্দ চাই তাঁর। সুন্দর ও সমানাধিকারের এক জীবন না দিতে পারলেও সন্তানের দেহ যেন দেশের মাটিতেই মিশে থাকে। জুড়ে তো থাকুক পূর্বপুরুষদের সঙ্গে এক জল-হাওয়া-ফুল ও ফলের সঙ্গে। সাতপুরুষ ধরে বাসন মেজে-হেঁশেল ঠেলে রেহানারা ক্লান্ত হননি। সরকারের নানা বাহানায় তাঁরা এ বার ক্লান্ত বোধ করছেন! মৌখিক তিন তালাক থেকে আইন করে শাপমুক্তি হয়েছে। ফলে তাঁদের জীবনে কী পরিবর্তন হয়েছে সেটা আজও তাঁরা জানেন না।

Advertisement

আবার ধর্ষণের কঠোর আইন ঘরের মেয়েদের খুব বেশি নিরাপদ করতে পারেনি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাড়ি ফেরা ও শালীন পোশাকের নিয়মে আজও মেয়েদের বাঁধতে হচ্ছে মা-দাদিদের। নোটবন্দিতেও তাঁদের কম হেনস্থা হয়নি! হাঁড়িতে ভাত ফোটানোর দায় মায়েদের। এ দিকে খরচ বাঁচিয়ে সংসারে লুকিয়ে রাখা টাকা জমা দেওয়ার জন্য তোলপাড় চলেছে দিনের পর দিন। তার পরে অসম থেকে উড়ে আসা ডিটেনশন ক্যাম্পের মেয়েদের ও কাশ্মীরের মেয়েদের বিপর্যয়ের কথা শুনে দাদিদের বিচলিত হওয়ারই কথা।

বেশিরভাগ মেয়েদের সংবিধান বোঝার আগেই ঘর-সংসার বুঝে নিতে হয়। আদর্শ নাগরিক হয়ে ওঠার আগেই আদর্শ গৃহিনী হওয়ার পাঠ পড়ে নিতে হয়। স্বামীর সংসারই দেশ ও কর্মভূমি। সেখানকার বিধান জন্মভূমির চেয়ে বড় তখন। এই সীমানার বাইরে সবটাই অপ্রাসঙ্গিক। তবুও সংসারের অধিকার বুঝে নিতে ব্যর্থ মুখচোরা মেয়েরা অবশেষে রাষ্ট্রের কাছে নিজের দাবি জানাতে সরব হতে পারছেন। এর চেয়ে সুখবর ও বড় উৎসব হতে পারে না। আন্দোলন–বিপ্লব মেয়েদের জন্য নয়। এমনটা আজও প্রতিষ্ঠিত। পথের নিরাপত্তাহীনতাই তাঁদের অন্দরমহলে ফেরাবে। এমনটাই নিশ্চিত। সেই ভাবনায় বড় ছেদচিহ্ন টানছে শাহিনবাগ। বছর শুরুতে এক নতুন জাতকের সন্ধান। তাই, আসমা দাদি জিন্দাবাদ।

চুপ থাকার সত্যি কোনও কারণ হয় না। সংসারের প্রতি ভালবাসা মানেই স্বামীর অত্যাচার নীরবে সয়ে যাওয়া নয়। তেমনই দেশপ্রেম আছে বলে সংসদে পাশ হওয়া আইনের প্রতি নিশঃর্তে আস্থা রাখা নয়। দাদিরাও হয়তো বুঝেছেন, প্রতিবাদ শান্তিপূর্ণ হোক তখনই প্রস্তাব করা যায় যখন প্রতিবাদ আটকানোর পদ্ধতিটিও গণতান্ত্রিক হয়। পুলিশের দায়িত্ব হিংস্রতা আটকানো। তেমনই হিংস্রতার সঙ্গে যুক্ত নয় এমন পথচলতি কাউকে ধরে নিয়ে শাস্তি দেওয়াও আইনের কথা নয়। চেহারা দেখে সহনাগরিকের রাষ্ট্র পাকিস্তান বলে দেওয়া নয়। সন্ত্রাসবাদী খুঁজতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ঢুকে অত্যাচার চালানো নয়। প্রতিবাদের সঙ্গে দেশপ্রেম জুড়ে দিয়ে দেশকে পক্ষ ও বিপক্ষে ভাগ করে বয়ান পেশ করা সরকারের কাজ নয়। দেশের ভোটাধিকারপ্রাপ্ত নাগরিককে তাঁর ধর্ম ও পোশাক পরিচ্ছদের কারণে হীনমন্যতায় ভুগতে বাধ্য করাও নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের অগণতান্ত্রিক আইন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাদিদের প্রতিবাদ আপাতত ইতিহাসবন্দি। নিজের সাত পুরুষের নাম ঘোষণা করে ভারতভূমিতে নাগরিকত্বের দাবি ঘোষণা ও সরকারের কাছে চিৎকার করে শাসকের সাত পুরুষের নাম জানানোর চ্যালেঞ্জ নিশ্চিত ভাবেই দেশের মেয়েদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।

আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আনা ইমপিচমেন্টকে যখন ট্রাম্প আমেরিকার সংবিধানের উপর আক্রমণ বলেন তখন আমাদের হাসি পায়। কারণ এই হাসি পাওয়ার অধিকারের ভিত মজবুত করেছে ভারতীয় সংবিধান। ক্ষমতায় টিকে থাকার বিপন্নতার মুখোশটা আমরা দেখতে পাই। নির্বাচিত সরকার ও দেশের সংবিধান একে অন্যের পরিপূরক হয় না। সংবিধানকে মানা মানেই সরকারের সব সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো নয়। সংবিধানের প্রতিটি শব্দকে বাস্তব করার জন্য জনগণ শাসককে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচন করে। সংবিধানের শপথ নিয়ে জনগণ ও দেশের উন্নতিকে ফুৎকারে উড়িয়ে শাসক সেই নির্ধারিত সময়ে ক্ষমতার স্বার্থ চরিতার্থ করার ব্রত নিলে তা ধরা পড়ে। সরকারি নিয়ম-নীতি সম্পর্কে যদি জনগণকে নিরন্তর ভুল বোঝানো হতে থাকে এবং তাঁদের অন্ধকারে রেখে তাঁদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয় তবে প্রতিবাদ দ্বিধাহীন হয়। এই দেশের আট থেকে আশি বছরের মেয়ে তা প্রমাণ করল।

জনগণকে দমিয়ে দেওয়া সহজ। সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসকের নখদর্পণে। কিন্তু সেই দমিয়ে রাখা চিরকালের জন্য সম্ভব নয়। ক্ষমতার লেন্সে তা শুধু দেখা যায় না। বিপর্যয় সেখানেই। সব ইতিহাস বদলের পরাক্রম এ ভাবেই ভরাডুবি আনে। বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল ও অরাজকতায় ভরা দেশের শাসকের তাই সবচেয়ে ব্যয়সাধ্য কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনী। এখানেই দাদিদের ঘর ও রাষ্ট্রের এক অমোঘ সাদৃশ্য। হাসিখুশি পরিবার সেটাই যেখানে গৃহিণী স্বাধীন ও সন্দেহের উর্ধ্বে। জনগণের স্বার্থ রক্ষাই যখন দেশের একমাত্র উদ্দেশ্য তখনই শাসক আদর্শ। দেশপ্রেম যখন রাজনৈতিক হাতিয়ার তখন গণতন্ত্র বেঘোরে মৃত্যুর অপেক্ষায়। দাদিদের আগাম ঝাপসা দৃষ্টির সতর্কতায় আমরা কত দূর দেখতে পাচ্ছি তার উপর দাঁড়িয়ে আমাদের আগামীর জীবন ও জীবিকা।

লেখক শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement