কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হেনস্থা নতুন ঘটনা নয়। মেয়েদের ওপর এমন নির্যাতনের ভিত্তি যে ক্ষমতার বিন্যাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেও আজ জানা। ১৯৯২-এ রাজস্থানের ‘সাথিন’ পদে কর্মরতা ভামরি দেবীর ধর্ষণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধে সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন আসে। ভামরি দেবীর নির্যাতনকারী ছিলেন গ্রামের তথাকথিত উঁচু জাতের পুরুষ। এই দেশে জাতভিত্তিক বৈষম্য এত সুগভীর যে, ভামরি দেবীর ঘটনায় রাজস্থান হাইকোর্ট রায় দেয় এই ধর্ষণ ঘটেনি, কারণ উঁচু জাতের পুরুষ নিচু জাতের মহিলাকে কখনওই স্পর্শ করবে না!
কাজের জায়গায়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দেনা-পাওনা আছে এমন যে কোনও সম্পর্কেই যৌন নির্যাতন ঘটতে পারে। যে কোনও সুবিধা, পেশাগত লাভ, পরীক্ষায় কিংবা গবেষণায় ভাল ফলের বিনিময়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপন হেনস্থার আওতায় পড়ে। যখনই দেনা-পাওনার ভিত্তিতে যৌন সম্পর্ক হয়, তখন মেয়েটির সম্মতি আছে কি না, এই প্রশ্ন অবান্তর। এই ধরনের নির্যাতনের ক্ষেত্রে সম্মতির প্রশ্নটিকে একমাত্রিক ভাবে দেখলে চলবে না। ক্ষমতার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিটিকে ‘না’ বলতে পারা সব সময় সহজ নয়। অনেক সময়ই বাস্তব দায়দায়িত্ব, ভবিষ্যতের ভয়, অনুচ্চারিত হুমকি, এই মেয়েদের অনিচ্ছা প্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই কারণেই মেয়েরা বহু বছর বাদে, যখন নিজের অবস্থা বদলায়, ভয়ের অথবা ক্ষতির কারণ থাকে না, তখনই যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ্যে আনেন। সেই জন্যই নির্যাতিতাকে ‘তখন কেন বলোনি’ বলা কখনওই বাঞ্ছনীয় নয়। নির্যাতিতার প্রতি এই দোষারোপ আদতে পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধকেই জোরদার করে, অপরাধীকে আড়াল করে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৭-র মধ্যে ৫৪% কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার ঘটনা বেড়েছে। ২০১৮ থেকে ২০১৯-এ এই বৃদ্ধির হার ১৪%। এই সংখ্যার বাইরেও এক বিরাট সংখ্যক মেয়ে আছেন, যাঁরা কোথাও অভিযোগ দায়ের করেননি। প্রসঙ্গত, আমাদের দেশে মেয়েদের কর্মী-সমাজে অংশগ্রহণ ক্রমশ কমছে। এই সংখ্যা কমার একটি কারণ কিন্তু কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনও বটে।
২০১৩ সালে আইন হওয়া সত্ত্বেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধে কমিটি গঠন এখনও হয়নি, অথবা কমিটি থাকলেও সেই কমিটির সাধারণত ক্ষমতাবানের পক্ষেই সায় দেওয়ার প্রবণতা। ফলে এ দেশেও মেয়েরা সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিযুক্তের নাম প্রকাশ করছেন, ‘মি টু’ আন্দোলন শুরু করেছেন। অনেক বিশিষ্ট জনই বলছেন, বিচারের সাংগঠনিক পদ্ধতির অর্থাৎ ‘ডিউ প্রসেস’-এর দ্বারস্থ না হয়ে এমন সরাসরি আক্রমণ কাম্য নয়। কিন্তু আমাদের দেশে যে কোনও ‘ডিউ প্রসেস’ কী ভাবে কাজ করে তা অজানা নয়। সংস্থার নিজস্ব কমিটি হোক, অথবা রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা, কেউই পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে নয়। বিচারের বাণী বেশির ভাগ সময় ক্ষমতাবানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
অভিযুক্তকে সরাসরি আক্রমণ অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রমাণ প্রকাশ অভিযুক্ত ও তার পরিবারের মানহানি হয়। অমূলক অভিযোগের আশঙ্কা থাকে না তা-ও নয়। অবশ্যই অভিযুক্ত, এমনকি অপরাধীরও, গোপন বিচারপদ্ধতিতে অধিকার আছে, কিন্তু একই সঙ্গে অভিযোগকারিণী মেয়েদেরও ইচ্ছেমতো যৌন অত্যাচারীর নাম প্রকাশের অধিকার আছে। আমাদের সমাজে যৌন অত্যাচারকে অপরাধীর অন্য গুণাবলির কারণে হামেশাই লঘু করে দেখা হয়। যৌন নির্যাতন সম্পর্কে প্রচলিত লব্জ শোনা যায়, অমুকবাবু এত বিদ্বান, এত নামী শিল্পী, স্নেহপ্রবণ শিক্ষক, তমুকের ছেলে অথবা ভাই, মেয়েদের অধিকারের সপক্ষে এত প্রবন্ধ লেখেন— অতএব উনি মেয়েদের যৌন হেনস্থা করতে পারেন না। এই বিশ্বাস থেকে প্রায়শই অভিযোগকারিণীকে মিথ্যেবাদী, সুবিধেবাদী প্রমাণের চেষ্টা হয়। অর্থাৎ যৌন হেনস্থার বিচার হয় অভিযুক্তের অপরাধের ভিত্তিতে নয়, অভিযুক্তের অন্যান্য সদর্থক ভূমিকার ভিত্তিতে। আর এই পিতৃতান্ত্রিক একদেশদর্শিতার জন্যই মেয়েদের সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিযুক্তের মানহানির পথ বেছে নিতে হয়।
যৌন অত্যাচারের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র অত্যাচারকারীর ক্ষমতার অবস্থানই বিচার্য নয়, মেয়েদের আর্থসামাজিক ক্ষমতার অবস্থানের ওপরও নির্যাতনের সম্ভাবনা নির্ভরশীল। যেমন শহরের সংখ্যাগুরু অথবা সাবর্ণ সম্প্রদায়, উচ্চবিত্ত শ্রেণির মেয়েদের যৌন হেনস্থা প্রতিরোধ শক্তি ক্ষমতার সোপানতন্ত্রে নীচের দিকে থাকা মেয়েদের তুলনায় সাধারণত বেশি। আবার এই ক্ষমতার সোপানও বহুমাত্রিক। মেয়েটির কোন পরিচয় তাঁকে যৌন নির্যাতনের সহজ শিকার করে তুলবে, তা তাঁর জীবনের পরিস্থিতির ওপরই নির্ভর করে। সেই জন্যই নির্যাতিতার দিকে আঙুল না তুলে, মেয়েদের জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাক্ষেত্র এবং যৌন হেনস্থার নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি জানানো বেশি জরুরি।