যৌন পরিষেবা প্রদানের পেশাকে আজ অবধি সমাজ পেশার সম্মান দিয়ে উঠতে পারেনি।
২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতের ৮১ শতাংশ মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিযুক্ত। যৌন পরিষেবা প্রদানও তেমনই একটি ক্ষেত্র। অতিমারির ধাক্কায় অসংগঠিত ক্ষেত্র কী ভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, তার ছবিগুলো ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। যৌন পরিষেবা ক্ষেত্রে অতিমারির ধাক্কা কতখানি লাগল, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে আমপান ঝড়ের কথাও আসবে। এই ঝড় গোটা দক্ষিণবঙ্গে যৌন জীবিকাকে আরও অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
গোটা দেশের মূলত ৩,০০০ মহিলা যৌনকর্মীর থেকে সমীক্ষার মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যের ওপর বছরকয়েক আগে একটি গবেষণা হয়েছিল। তার থেকে জানা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই যৌনকর্মীরা যৌন জীবিকাকে মূল জীবিকার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক জীবিকা হিসাবে দেখেন। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে এটাই রোজগারের একমাত্র উপায়। স্বভাবতই যৌন পেশাকে বুঝতে হলে শ্রম বাজারে থাকা অন্যান্য পেশার সঙ্গে এই পেশার যে সম্পর্ক আছে, তা বুঝতে হবে। যেমন ধরা যাক, এমন অনেক যৌনকর্মী রয়েছেন যিনি হয়তো মৌসুমি নাচিয়ে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচেন। আর যৌন পেশায় যুক্ত থাকেন বাকিটা সময়। তবে এর সঙ্গে এমনও অনেকে আছেন যাঁরা পূর্ণ ভাবে যৌন পেশায় নিযুক্ত। এই পেশায় ভাটা পড়লে তাঁদের পক্ষে অন্য কোনও জীবিকার সুযোগ নিতান্তই কম।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে আনুষঙ্গিক যৌন পেশার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের ইচ্ছে থাকলেও তাঁরা এই পেশাকে পূর্ণ ভাবে জীবিকা নির্বাহের কাজে লাগাতে পারেন না। তার প্রথম কারণ হল, যৌন পরিষেবা প্রদানের পেশাকে আজ অবধি সমাজ পেশার সম্মান দিয়ে উঠতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, যৌন পেশার সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা অনেক ক্ষেত্রেই সমাজের এক বিশেষ শ্রেণি, জাতি, এবং বর্ণ থেকে উঠে আসেন। মূলত দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী শ্রেণি এবং দলিত বর্গ থেকে উঠে আসা মহিলার সংখ্যা যৌন পেশায় সর্বাধিক। এর ফলে দুই স্তরে বৈষম্য ঘটে থাকে। এক, তাঁদের শ্রেণি এবং জাতিগত অবস্থানের কারণে; দুই, তাঁদের এই পেশায় যুক্ত হওয়ার কারণে। অনেক ক্ষেত্রেই কোনও ক্রমে আর্থিক সংস্থান হলেও বৈষম্য কিন্তু ঘোচে না।
আরও পড়ুন: রাষ্ট্রের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলির হাতে যখন অধিকার সুরক্ষিত নয়
এই রকম অতিমারির সময় সামাজিক বিপন্নতা আরও কঠিন হয়ে হয়ে ওঠে। যৌনশ্রমের দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মূলধন হল দেহ এবং শারীরিক সংস্পর্শ। অথচ এই অতিমারির হাত থেকে বাঁচতে হলে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখতে হচ্ছে। যে জীবিকা দাঁড়িয়েই আছে শারীরিক নৈকট্যের ওপর, সেই জীবিকা কী ভাবে সম্ভব হবে এই পরিস্থিতিতে ?
বসিরহাটের মাটিয়ায় যৌনকর্মীদের মুখে এই কথাগুলোই উঠে আসে বার বার। প্রশ্নটা যদিও আরও গভীর— বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকাংশেই লকডাউন উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু অতিমারির প্রকোপ কম হয়নি, বরং বেড়েছে। মানুষের মধ্যে ভীতি এবং সেই ভীতি থেকে জন্ম নেওয়া বিভেদমূলক আচরণ ক্রমশ বেড়েছে। এই রকম অবস্থায় তাঁদের পক্ষে জীবিকা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব রকম কঠিন। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে সেই যৌন কর্মীদের উপর যারা এই পেশাতেই একমাত্র নিযুক্ত, অন্য কিছুতে নয়।
ইতিহাসে প্রমাণ আছে, এইচআইভি এডস যখনই মহামারির আকার নিয়েছে, তখন সবচেয়ে বেশি হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে যৌনকর্মীদের। যদিও আজ অনেকেই এটা জানেন যে অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক এইচআইভি এডস-এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা। পরবর্তী সময়ে যখন কন্ডোমের ব্যবহার শুরু হয় রোগ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হিসাবে, তখনও দেখা গিয়েছে যে যৌনকর্মীরা নিজেদের সুরক্ষার কারণে সে বিষয়ে সচেতন হলেও অনেক ক্ষেত্রেই যৌন পরিষেবার ক্রেতা সহমত পোষণ করেন না। বাধ্য হয়ে কর্মীকে অসুরক্ষিত সম্পর্কে যেতে হয়। সংক্রমণের কারণ হিসাবে এই বিষয়কে কখনও তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, বরং যৌনকর্মীদেরই তার দায় বইতে হয়েছে। এইচআইভি এডস-এর ক্ষেত্রে তবু কন্ডোম ব্যবহার করলে রোগ সংক্রমণ ঠেকানোর উপায় ছিল। কোভিড-১৯’এর ক্ষেত্রে সংক্রমণ যেহেতু ড্রপলেট-বাহিত, ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক নৈকট্য ঘটলে রোগ সংক্রমণ ঠেকানো মুশকিল। ফলে, যৌনকর্মীরা নিতান্তই আতান্তরে পড়েছেন।
তার ওপর আমপানের ধাক্কা। যে সব নিম্নবিত্ত গ্রাহকরা এক সময় বসিরহাট অঞ্চলে আসতেন যৌনকর্মীদের কাছে, তাঁদের অনেকেই আজ জীবিকা হারিয়েছেন, হারিয়েছেন তাঁদের ঘরবাড়ি। যৌন পরিষেবার পিছনে খরচ করার মতো টাকা তাঁদের আর নেই। দুর্যোগ-পরবর্তী অনুদান পৌছয়নি যৌনপল্লিতে। ‘এখানে কেউ আসে না’— এই কথাই বার বার উঠে এল বসিরহাট দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির যৌনকর্মীদের কথায়।
প্রশ্ন হল, লকডাউনের সময় অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিযুক্ত মানুষের কাছে নেই নেই করেও যে সরকারি অনুদান পৌঁছেছে, আমপানের পর বিপর্যস্তদের কাছে যে ত্রাণ পৌঁছেছে, যৌনকর্মীদের কাছে তা পৌঁছয় না কেন? কেন তাঁরা সরকারি সাহায্য বণ্টনের ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হন? এই প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হল, সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি রাষ্ট্রও যৌন পরিষেবা প্রদানকারী কর্মীদের এখনও শ্রমিক ভেবে উঠতে পারেনি। কাটিয়ে উঠতে পারেনি সামাজিক কলঙ্কের দাগ।
সেন্টার অব সোশ্যাল মেডিসিন অ্যান্ড কমিউনিটি হেলথ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়; ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, দিল্লি