ফাইল চিত্র।
আলুর দাম বড়ই অবাধ্য। ত্রিশ টাকার উপরে চড়িয়া বসিয়াছে, সরকারের ধমকেও নামিবার নামটি নাই। কর্তারা মাঝেমাঝেই ভয় দেখাইতেছেন, ‘এই বার না নামিলে কিন্তু...।’ তাহাতে কাজ হয় নাই। আলুর বেয়াদবির সঙ্গী হইয়াছে ঝিঙা, পটল, পেঁপে প্রভৃতি আপাত-নিরীহ আনাজও। চাষির ঘর হইতে যাহারা সামান্য দরে উঠিয়াছিল ব্যবসায়ীর ট্রাকে, ক্রেতার ব্যাগে ঢুকিবার সময়ে তাহারাই অগ্নিমূল্য। দেশে শিল্প উৎপাদন কমিয়াছে, বেকারত্ব বাড়িয়াছে, তাহাতে আলু-পটলের কী আসিয়া গেল? ক্রেতারা শোরগোল জুড়িয়াছেন। চালু-আলু ভিন্ন তাঁহাদের রসুই অচল। অগত্যা সরকারও ফের আঁকশি হস্তে বাজারে নামিয়াছে। ইতিপূর্বে অনেক বার বাক্-ঔষধে ব্যবসায়ীদের দাম চড়াইবার রোগ সারিয়াছে। কিন্তু এই বার এক মাস ধরিয়া সতর্কবার্তা জারি করিয়াও দাম কমে নাই। যে আলু এগারো টাকা কিলোগ্রাম দরে চাষির ঘর ছাড়িয়াছিল, তাহাই ৩৫ টাকা কিলোগ্রাম দরে খুচরা বাজারে খেলা করিয়া ফিরিতেছে। সরকারি হিসাবে, তাহার দাম ২২ টাকা কিলোগ্রাম করিলে যথেষ্ট। তাহাতেই হিমঘর, পরিবহণ ও অন্যান্য খরচ উঠিয়া আসিবে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের সহিত তিন বার বৈঠক করিয়াও আলুর দর ৩০ টাকা কিলোগ্রামের নীচে নামে নাই। সরকার আবারও হুঁশিয়ারি দিয়াছে, প্রয়োজনে সরকার স্বয়ং বিক্রেতার ভূমিকা লইয়া আলুর দামকে শাসন করিবে।
সরকারের নিজস্ব বিপণন কেন্দ্রগুলি হইতে ন্যায্য দরে আলু বিক্রয় করিলে তাহার প্রভাব বাজারে পড়িতে পারে, যদি তাহার পরিমাণ যথেষ্ট হয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠিবে, আনাজের দাম নিয়ন্ত্রণ করিতে সরকারকে বার বার বিক্রেতার ভূমিকা লইতে হইবেই বা কেন? যে কোনও ব্যবসায় দুর্নীতি রুখিবার কাজটি সরকারের উপর বর্তায়, ইতিপূর্বে আলু ও অন্যান্য আনাজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখিতে কমিটিও হইয়াছে। পটল প্রভৃতি আনাজের উৎপাদন অবশ্য সম্প্রতি বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে, ফলে তাহার জোগান কমিয়াছে। তাহার ফলে সাময়িক মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক নহে। উৎপাদন স্বাভাবিক হইলে দামও যথাযথ হইবে, আশা করা যায়। কিন্তু আলুর উৎপাদন ও বিপণনের মধ্যে হিমঘরে মজুত রাখিবার, এবং মজুত আলুর রসিদ বা ‘বন্ড’ লইয়া ফাটকা খেলিবার একটি দীর্ঘ প্রথা পশ্চিমবঙ্গে চলিয়া আসিতেছে। তাহা নিয়ন্ত্রণ করিতে প্রশাসনিক নানা পদক্ষেপ হইয়াছে বটে, কিন্তু রাজনীতি প্রবেশ করায় নিয়ন্ত্রণের রাশটি আধিকারিকদের হাতে বিশেষ নাই।
চাষির নিকট হইতে ন্যায্য মূল্যে কৃষিপণ্য ক্রয় এবং যথাযথ মূল্যে তাহা ক্রেতাকে বিক্রয়, এই প্রক্রিয়াতে প্রায়ই বাধা হইয়া দাঁড়ায় দলীয় রাজনীতি। ইহাতে দরিদ্র চাষি ও সাধারণ ক্রেতা, উভয়েরই ক্ষতি। লাভবান হয় মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি। এই পরিস্থিতিতে সরকারের দুর্বলতা বাড়াইতেছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে সাম্প্রতিক সংশোধন, যাহা আলু ও পেঁয়াজকে অত্যাবশ্যক পণ্যের তালিকার বাহিরে রাখিয়াছে। দাম বাঁধিবার ক্ষমতা রাজ্য সরকার হারায় নাই, কিন্তু পদ্ধতি আরও জটিল হইয়াছে। অতএব পুরাতন পদ্ধতিতে আবদ্ধ না থাকিয়া, কৃষিপণ্যের বিপণনে সংস্কার আনিতে আরও উদ্যোগী হইতে হইবে সরকারকে। বৃহৎ সংস্থার নিকট সরাসরি ফসল বিক্রয়, হিমায়িত পরিবহণ, ফসল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ, ইত্যাদি সংস্কারের দাবি তোলা জরুরি।