—ফাইল চিত্র।
ভারতে বৈধ চিকিৎসকের তুলনায় ছায়া-চিকিৎসক, অর্থাৎ ডিগ্রিহীন ডাক্তারের সংখ্যা অধিক। ইহাদের মূলস্রোতের চিকিৎসার সহিত যুক্ত করিবার প্রস্তাব বার বার উঠিয়াছে। চিকিৎসক সংগঠনগুলি তাহার বিরোধিতা করিয়াছে। সম্প্রতি সে প্রশ্নের আংশিক নিষ্পত্তি হইল। সংসদ পাশ করিল ‘ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিল বিল’। নূতন আইন বলবৎ হইলে প্রাথমিক চিকিৎসার উপযোগী ঔষধের প্রেসক্রিপশন লিখিতে পারিবেন ‘জনস্বাস্থ্য পরিষেবক’ (কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার)। উন্নত স্তরের চিকিৎসার ঔষধও তাঁহারা লিখিতে পারিবেন, কিন্তু ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে। ‘জনস্বাস্থ্য পরিষেবক’ লাইসেন্স পাইতে গেলে কী যোগ্যতা আবশ্যক, কী কী শর্ত পূরণ করিতে হইবে, আইনে সে সকল কথা বিশদ বলা নাই। জাতীয় মেডিক্যাল কাউন্সিল গঠিত হইলে তাহার সদস্যরা সেই সকল শর্ত নির্ধারণ করিবেন। কিন্তু ঔষধ লিখিবার ক্ষমতা, যাহা অর্জন করিতে এত দিন চিকিৎসাশাস্ত্রের পাঠ সম্পূর্ণ করিতে হইত, তাহা প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি শ্রেণির হাতে তুলিয়া দিল সরকার। নূতন আইনের নির্দেশ, লাইসেন্স-প্রাপ্ত জনস্বাস্থ্য পরিষেবকের সংখ্যা বৈধ চিকিৎসকদের এক-তৃতীয়াংশ ছাড়াইতে পারিবে না। ভারতে বর্তমানে আট লক্ষ নথিভুক্ত চিকিৎসক রহিয়াছেন। অতএব আড়াই লক্ষাধিক অ-চিকিৎসক ঔষধ লিখিবার ছাড়পত্র পাইবেন।
ডাক্তাররা আপত্তি জানাইয়া বলিয়াছেন, অ-চিকিৎসক ঔষধ লিখিলে রোগের জটিলতা বাড়িবে। প্রশ্ন হইল, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে যথেষ্ট সংখ্যক চিকিৎসক কোথায়? প্রশিক্ষিত ডাক্তাররা গ্রামে যাইতে অরাজি; না কি গ্রামে চিকিৎসা পরিকাঠামোর অভাবই তাঁহাদের বিমুখ করে— এই বিবাদ সহজে মিটিবার নহে। কিন্তু, তাহাই একমাত্র সমস্যা নহে। ভারতে রোগী-চিকিৎসক অনুপাতটি অতিশয় মন্দ। যথেষ্ট চিকিৎসক তৈরি করিতে যত মেডিক্যাল কলেজ প্রয়োজন, তত তৈরি করিবার সাধ্য সরকারের নাই। অতএব অন্য উপায় ভাবিতে হইবে। বহু দেশে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা হইয়াছে, উপকারও মিলিয়াছে। ভারত সে পথে হাঁটিবে কি না, সেই প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়।
গ্রামের দরিদ্র মানুষের জন্য ‘দ্বিতীয় শ্রেণি’-র চিকিৎসা বরাদ্দ হইবে কেন, সেই প্রশ্ন অসঙ্গত নহে। কিন্তু চিকিৎসার মান নিশ্চিত করিতে গিয়া চিকিৎসক কম পড়িলে তাহা বৃহত্তর অন্যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সহিত সর্বত্র মেডিক্যাল প্রশিক্ষণের মেয়াদ ও খরচ বাড়িতেছে। ফলে বহু দেশেই নার্স, প্যারামেডিক প্রভৃতি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর প্রাথমিক চিকিৎসার দায়িত্বের কিছু অংশ ন্যস্ত হইয়াছে। তাহাতে স্বাস্থ্যচিত্রে অবনতির নজির নাই। কিন্তু, সেই উদাহরণ মানিয়া চলিতে হইলে সাবধান হওয়া প্রয়োজন। কাহারা এই জনস্বাস্থ্য পরিষেবক হইবার উপযুক্ত; তাঁহাদের কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হইবে; নির্দিষ্ট সময় অন্তর তাঁহাদের কাজের মূল্যায়ন করা হইবে কি না; সত্যই তাঁহাদের কোনও চিকিৎসকের অধীনে কাজ করা বাধ্যতামূলক হইবে কি না— প্রতিটি প্রশ্নেরই সুস্পষ্ট জবাব চাই। মানুষের স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। তাহাতে কোনও রকম ফাঁক রাখিলে চলিবে না।