Domestic Violence

ছকভাঙা

এই দৃঢ়তা প্রশংসনীয়। যে বয়সে শিকড়ের টান অপ্রতিরোধ্য হইয়া উঠে, সেই বয়সে পৌঁছাইয়া তিনি নিজ হস্তে শিকড় ছিঁড়িয়াছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০১৯ ০২:০৭
Share:

প্রতীকী ছবি।

তিনি বিদ্রোহ করিয়াছেন। বিদ্রোহ, জীবনের আটাত্তরটি বসন্ত অতিক্রম করিবার পরে। এবং তিনি প্রমাণ করিয়াছেন, দেওয়ালে এক বার পিঠ ঠেকিয়া গেলে বয়স আর বিদ্রোহের পথে কোনও বাধা হইতে পারে না। তিনি, জনৈক বৃদ্ধা। দীর্ঘ দিন যাবৎ একটানা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার। রোগ এবং বয়সের ভারে জীর্ণ হইয়াছে শরীর। তবু, অশীতিপর স্বামীর প্রহার হইতে নিস্তার পান নাই। অবশেষে গুরুতর রোগাক্রান্ত হইবার পর তাঁহার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙিয়াছে। নবজন্ম পাইয়া তিনি অনুভব করিয়াছেন— জীবন অতি মূল্যবান। প্রতিনিয়ত সেই জীবনকে এইরূপে অসম্মানিত হইতে দেওয়া যায় না। সুতরাং, এত কালের দাম্পত্যজীবনের যবনিকাটি নিজ হাতে টানিতে তিনি বদ্ধপরিকর। স্বামীর যাবতীয় হুমকি অগ্রাহ্য করিয়া চিকিৎসান্তে বৃদ্ধাশ্রমের পথে পা বাড়াইছেন তিনি, নিজ ঠিকানায় ফেরেন নাই।

Advertisement

এই দৃঢ়তা প্রশংসনীয়। যে বয়সে শিকড়ের টান অপ্রতিরোধ্য হইয়া উঠে, সেই বয়সে পৌঁছাইয়া তিনি নিজ হস্তে শিকড় ছিঁড়িয়াছেন। কিন্তু ইহা একটি দিকমাত্র। অন্য দিকটিতে শুধুই অন্ধকার। এই দেশে অগণিত মেয়ে প্রতিনিয়ত স্বামীর হাতে নির্যাতিত হইয়াও মুখ বুজিয়া থাকে। পরিসংখ্যান বলিতেছে, ভারতে ত্রিশ শতাংশের অধিক বিবাহিত মহিলা তাঁহার স্বামীর দ্বারা শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার। প্রতিবাদ করিবার সাহস তাঁহাদের কত জনের থাকে? যৌবনে তো বটেই, বৃদ্ধাবস্থায়ও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না। আগের রাত্রিতে মদ্যপ স্বামীর হাতে মার খাইয়া পর দিন সকালে সেই দাগ ঢাকিয়া তাঁহারা কাজে যান। কারণ, নিরাপদ আশ্রয়টি হারাইবার ভয়। সঙ্গে আজন্মলালিত সংস্কারের বাধা, মানাইয়া লইবার শিক্ষা। বৃদ্ধাও তো সহ্যই করিয়া আসিয়াছেন এত কাল। মেয়েদের সামনেই তাঁহাকে অসম্মানিত হইতে হইয়াছে, তিনি প্রতিবাদ করেন নাই। মেয়েদের অনুরোধেও সংসারের শিকল ছিঁড়িতে চাহেন নাই। অথচ তিনি নিজে উচ্চশিক্ষিত। বিকল্প সম্মানজনক পথটি বাছিয়া লইবার যথেষ্ট সুযোগ তাঁহার সামনে ছিল। কিন্তু সেই পথও তিনি বাছিয়া লন নাই। অনুমান, জীবনের শেষপ্রান্তে আসিয়া জীবনের মূল্য না বুঝিলে হয়তো কোনও দিনই তিনি বিদ্রোহের পথে হাঁটিতেন না। অস্বাভাবিক নহে। জন্মাবধি মেয়েদের শেখানো হইয়াছে, বিবাহের পর স্বামীগৃহই তাহার আসল ঠিকানা। শ্বশুরবাড়িতে সমস্যা আসিলেও তাহাকে মানাইয়া লইতে হইবে। বিনোদন জগৎও প্রতি সন্ধ্যায় এই শিক্ষাই দিতেছে। সহস্র অন্যায়ের সরাসরি প্রতিবাদ না করিয়া পরোক্ষে মন জয়ের চেষ্টাই সেখানে চরম গৌরবের। সুতরাং, উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের একাংশও যে সেই জোয়ারে ভাসিয়া ‘সুগৃহিণী’ হইবার সাধনায় মগ্ন হইবেন, তাহাতে আর আশ্চর্য কী!

তবে, সকলে সমান ভাবেন না। আর ভাবেন না বলিয়াই পরিবর্তন আসে। কিছু সৃষ্টিছাড়া ভাবনাই অচলায়তনে ফাটল ধরায়। সবল যখন দুর্বলের উপর নিষ্পেষণকেই ধর্ম মানিয়া লয়, তখনই প্রতিবাদ দানা বাঁধে। নিষ্পেষণ যত বাড়ে, বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদগুলি জুড়িয়া এক সময় প্রচলিত ছককে ভাঙিয়া দেয়। বৃদ্ধার স্বামীর কাছে অবাধ্যতার শাস্তি নির্মম প্রহার। এবং তাহা প্রতিবাদযোগ্যও নহে, নিতান্তই ঘরোয়া ব্যাপার। পুরুষতন্ত্রও তাহাই মনে করে। সকলেই সেখানে প্রহার মন্ত্রে দীক্ষিত না হইলেও, মেয়েদের যে স্বাধীন চিন্তার কোনও স্থান নাই, তাঁহারা যে সম্পূর্ণতই পুরুষের নিয়ন্ত্রণাধীন, সেই বিষয়ে নিশ্চিত থাকেন। বৃদ্ধার এই বিদ্রোহ সেই অচলায়তনে রাতারাতি কোনও পরিবর্তন আনিবে না, সত্য। কিন্তু তাঁহার মতো পড়িয়া মার-খাওয়া মেয়েদের কিছু ভরসা জোগাইবে। এক বিকল্প পথের সন্ধান করিতে উৎসাহ জোগাইবে। আশার কথা এইটুকুই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement