সম্পাদকীয় ২

সমানে চলিতেছে

এক কালে পরীক্ষার খাতায় ‘পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য’ বিশেষ নম্বর বরাদ্দ থাকিত। নরেন্দ্র মোদী পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য বিশেষ মাসুল ধার্য করিলেন। সকল করযোগ্য পরিষেবার উপর ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযান বাবদ ০.৫ শতাংশ সেস চাপিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৫ ০০:১৪
Share:

এক কালে পরীক্ষার খাতায় ‘পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য’ বিশেষ নম্বর বরাদ্দ থাকিত। নরেন্দ্র মোদী পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য বিশেষ মাসুল ধার্য করিলেন। সকল করযোগ্য পরিষেবার উপর ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযান বাবদ ০.৫ শতাংশ সেস চাপিল। বর্তমান অর্থবর্ষের পড়িয়া থাকা সাড়ে তিন মাসেই সেই সেস হইতে প্রায় চারশত কোটি টাকা রাজকোষে জমা পড়িবে। প্রধানমন্ত্রী জানাইয়াছেন, রাজস্ব বৃদ্ধির ফিরিক নহে, এই সেস স্বচ্ছতার অভিযানে প্রত্যেক নাগরিককে অংশী করিয়া তুলিবার প্রচেষ্টা। স্বচ্ছতা অতি উৎকৃষ্ট বস্তু, কিন্তু সে জন্য কেন বাড়তি সেস দিতে হইবে, তাহারও কোনও যুিক্তসঙ্গত কারণ নাই। রাজকোষে যে টাকা জমা পড়ে, তাহা দেশের নাগরিকেরই টাকা। শুধু আয়করদাতাদের নহে, যাঁহাদের আয়ের পরিমাণ করযোগ্য নহে, তাঁহারাও বিবিধ পরোক্ষ করের মাধ্যমে রাজকোষে টাকা দেন। স্বচ্ছ ভারত, বা অন্য কোনও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম সেই টাকাতেই চলে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের প্রতিটি কাজেই নাগরিকরা অংশী। যদি রাজকোষে যথেষ্ট টাকা না থাকে, তবে প্রয়োজন বোধ করিলে সরকার করের হার বৃদ্ধি করিতে পারিত। কিন্তু, স্বচ্ছ ভারত অভিযানের জন্য আলাদা সেস-এর প্রয়োজন ছিল না।

Advertisement

সেস বিষয়টি বিবিধ কারণে গোলমেলে। প্রথমত, পরোক্ষ করের মতোই, সেস আদায়ে ধনী-দরিদ্রে ফারাক করা হয় না। মুকেশ অম্বানী ও রামা কৈবর্ত একই হারে পরোক্ষ কর দিতে বাধ্য। অর্থনীতির পরিভাষায় এই গোত্রের করকে ‘রিগ্রেসিভ’ কর বলা হইয়া থাকে, তাহার কারণ দরিদ্রের উপর এই করের বোঝা সমানুপাতিক হারের তুলনায় ঢের বেশি পড়ে। কাজেই, নীতিগত ভাবে সেস পরিহার্য। দ্বিতীয় কথা, স্বচ্ছ ভারতের জন্য যদি সেস আদায় করিতেই হয়, তাহা এমন ভাবে করা বিধেয় যাহাতে উদ্দেশ্যের সহিত সেই সেস-এর সাযুজ্য থাকে। যেমন, যাহাতে দূষণ ছড়ায়, তেমন পণ্য ও পরিষেবার উপর সেস আদায় করা হইত, তাহার একটি অর্থ থাকিত। নরেন্দ্র মোদী যদি পুরসভাগুলিকে শহর পরিষ্কার রাখিবার জন্য তাহাদের বাড়তি অর্থের দাবি মিটাইবার জন্য পরিষেবা কর বৃদ্ধির পরামর্শ দিতেন, তবে তাহা অন্যায্য হইত না। নদীতে দূষণ ছড়ানো শিল্পগুলি হইতে ‘স্বচ্ছ ভারত কর’ আদায় করা হইলে বোঝা যাইত, সরকারের ভাবনাচিন্তার একটি নির্দিষ্ট দিশা রহিয়াছে। কিন্তু সকল করযোগ্য পরিষেবার উপর সেস বসানো হইলে অর্থনৈতিক বোধ এবং বৃহত্তর অর্থে কাণ্ডজ্ঞানের অভাব প্রকট হয়।

বোঝা যায়, নূতন কিছু ভাবিবার সামর্থ্য এখনও এই সরকার অর্জন করিতে পারে নাই। ভারতে সেস বস্তুটি নূতন নহে। বিবিধ ক্ষেত্রে বিচিত্র সব সেস আদায় করার রীতিটি প্রচলিত, এবং নরেন্দ্র মোদী পারিলে যে কংগ্রেস আমলকে ভারতের ইতিহাস হইতে মুছিয়া দেন, অভ্যাসটি সেই যুগেরই। যে কয়টি সেস প্রচলিত আছে, সেগুলির যাথার্থ্য বিচার করিয়া নিতান্ত ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র বাদে বাকি সব কয়টিকে বিদায় করিলে বরং নূতন ভাবনার পরিচয় পাওয়া যাইত। নরেন্দ্র মোদী সেই পথে হাঁটেন নাই। সন্দেহ হয়, তাঁহার মুখে যতই নেহরু-ইন্দিরা যুগের বিরোিধতা থাকুক, অন্তরে তাহারই অধিষ্ঠান। সংস্কারের গুরুত্ব খাটো করিয়া দেখানোতেই হউক, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মুষ্টি শিথিল করিবার অনীহাতেই হউক অথবা সেস আদায়ের চর্চিত পথে হাঁটিবার উৎসাহে, মনের অচলায়তনটি বারে বারেই দৃশ্যমান হইতেছে। দৃশ্যটি মনোহর নহে। উদ্বেগজনকও বটে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement