ঝড় আসিয়া জীবনকে বিপর্যস্ত করিয়া যায় বটে, কিন্তু জীবনের শিক্ষাও নিহিত থাকে সেই তুফানেই। যাঁহারা পারেন, শিখিয়া লন। স্কুলশিক্ষিকা প্রভাতী মণ্ডল যেমন। কুলতলির মালপাড়ার ঝঞ্ঝা-বিধ্বস্ত গ্রামকে তিনি স্বনির্ভরতার আদর্শে পুনরুজ্জীবিত করিয়াছেন। বিভিন্ন সংগঠন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের একত্র করিয়া শুরু করিয়াছেন আহার্য প্রস্তুত ও বিতরণের শিবির। ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নহে। কিন্তু শূন্য হাতে নিশ্চেষ্ট হইয়া থাকিবার তুলনায় বহু গুণ ভাল। তাহাতে অর্ধভুক্ত থাকিতে হইতে পারে, কিন্তু পরমুখাপেক্ষী হইয়া বাঁচিবার অসহায়তা থাকে না। গ্রামের মানুষ বহু ক্ষেত্রেই স্বনির্ভরতার এই মন্ত্রটি মানিয়া চলেন। কোনও আদর্শ মানিবার তাগিদে নহে। তাঁহারা জানেন, প্রশাসনের সহায়তা তাঁহারা সামান্যই আশা করিতে পারেন। কোভিড-১৯’কে কেন্দ্র করিয়া বিচিত্র উপায়ে এই স্বেচ্ছা-উদ্যোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিতেছে। পুরুলিয়ার বলরামপুরে একটি গ্রামের বৃহৎ গাছে পাঁচ-সাতটি তক্তপোশ বাঁধিয়া প্রত্যাগত অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য কোয়রান্টিন কেন্দ্র নির্মাণ তাহারই দৃষ্টান্ত। অনেক এলাকার মানুষ সংগঠিত হইয়া কর্মহীন বাসিন্দাদের আহার, ঔষধ জুগাইতেছেন। কখনও ত্রাণ-সম্পর্কিত সমীক্ষা করিলে হয়তো স্পষ্ট হইবে, লকডাউনে বিপন্নদের পরিত্রাণে সরকারি সহায়তার তুলনায় এলাকাবাসীর উদ্যোগের ভূমিকা কম নহে। আমপানের ধ্বংসলীলার পর ক্ষুধার্ত, নিরাশ্রয় গ্রামবাসী কেবল প্রশাসনের মুখের দিকে চাহিয়া বসিয়া নাই। তাঁহারা সর্বশক্তিতে নিজেদের পরিস্থিতির মোকাবিলা করিতেছেন।
গ্রামবাসীর আত্মশক্তিকে সর্বাধিক মর্যাদা দিয়াছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গাঁধী। বামপন্থীরাও স্বশাসিত গ্রামের আদর্শ সমর্থন করিয়াছিল। ভারত গ্রাম পঞ্চায়েতকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেয় ১৯৯২ সালে। গ্রামের প্রতিটি চাহিদা মিটাইতে কেন্দ্র অথবা রাজ্য সরকারের মুখাপেক্ষী হইতে হইলে বিস্তর বিলম্ব ঘটে, যথাযোগ্য স্থানে যথাযথ সহায়তা পৌঁছাইবার কাজে ত্রুটি রহিয়া যায়। স্থানীয় উদ্যোগ অধিক কার্যকর। আক্ষেপ, পঞ্চায়েতের স্বাতন্ত্র্যকে ক্রমাগত খর্ব করিয়াছে প্রায় সকল রাজ্যের সরকার। দলীয় রাজনীতির বাহিরে পঞ্চায়েতকে তাহার আপন নিয়মে কাজ করিতে দিবার পরিসর এ রাজ্যেও সঙ্কুচিত হইয়াছে। জেলা প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হইয়াছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা গ্রামবাসীর প্রয়োজন সম্পর্কে সর্বাধিক অবহিত, তবু কর্মসূচির পরিকল্পনা ও রূপায়ণে তাঁহাদের মতামত উপেক্ষিত হইতেছে। দলীয় স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির জেরে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার উপর গ্রামের মানুষের আস্থাও কমিতেছে।
তৎসত্ত্বেও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কার্যকারিতা হারায় নাই। আমপানে প্রাণক্ষয় কম হইবার অন্যতম কারণ, গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি গ্রামবাসীকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরাইবার বিষয়ে তৎপর হইয়াছিল। বহু ত্রাণ শিবিরের সংগঠনেও তাহাদের সহযোগিতা যথেষ্ট। স্বনির্ভরতার আদর্শ খর্ব হইলেও, নষ্ট হয় নাই। তৎসহ স্থানীয় শিক্ষক, সমাজসেবীদের ভূমিকাও সম্মান দাবি করে। মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রকে বলিয়াছেন, ইহা ক্ষুদ্র রাজনীতির সময় নহে। গ্রামবাসীরাও তাঁহাকে সে কথা স্মরণ করাইতে পারেন। এই ভয়ানক ক্ষয়ক্ষতির মোকাবিলায় ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে গ্রামবাসীর প্রচেষ্টাকে পুষ্ট করিবে সরকার, ইহাই প্রত্যাশা।