প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা চুকিয়ে পড়তে গেলাম অক্সফোর্ডে। সেই ১৯৮৪ সালে স্টিফেন হকিংয়ের বক্তৃতা প্রথম শুনি। তখনও তিনি কথা বলতে পারেন। মনে আছে তখন হুইলচেয়ারে বসেই বক্তৃতা করেছিলেন। মাথা এক দিকে হেলে রয়েছে। কিন্তু ওঁর কথা বোঝা যেত।
সেই সময় কেমব্রিজ থেকে অক্সফোর্ডে বার বারই আসতে দেখতাম হকিংকে। আসতেন তাঁর গবেষণাসঙ্গী রজার পেনরোজের কাছে। ওই সময় ওঁদের ব্ল্যাক হোল নিয়ে যুগ্ম গবেষণাপত্র বেরোনোর তোড়জোড় চলছে। ১৯৮৫-৮৬ সালে হকিংয়ের বড় অপারেশন হল। কথা বলার ক্ষমতা এর পর ওঁর ধীরে ধীরে চলে গেল।
অক্সফোর্ডে স্নাতক স্তরের পড়াশোনার পরে চলে গেলাম কেমব্রিজে পিএইচ ডি করতে। সেখানে কর্তৃপক্ষ আয়োজন করেছিলেন বারো পর্বে হকিংয়ের লেকচার, ‘আ শর্ট হিস্ট্রি অব টাইম’। পরে একই বিষয়ে শিরোনামের ঈষৎ বদল করে প্রকাশিত যে বই পৃথিবীকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছে। সেই বক্তৃতার নোট এখনও আমার কাছে আছে। ওই বক্তৃতা শোনার জন্য আসন পেতে এক ঘণ্টারও আগে পৌঁছতে হত হলে।
সেই সময়ও হকিং শুধুই এক জন বিজ্ঞানী। পদার্থবিদ্যা ও সৃষ্টিতত্ত্বের নিয়ে আগ্রহী গবেষক, ছাত্রদের কাছেই তিনি তখন শুধু পরিচিত। কিন্তু ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ প্রকাশিত হওয়ার পরে তিনি আর শুধু নিছক বিজ্ঞানী ছিলেন না। এই বই হকিংকে গবেষণাগারের বাইরে পাবলিক ফিগার বানিয়ে দেয়। বলা যেতে পারে তিনি ছিলেন গালিলেয়ো আর আইনস্টাইনের মেলবন্ধন। মহাবিশ্বের সঙ্গে যে মানবসভ্যতার যোগাযোগ রয়েছে, সেই বিশ্বাসকে তিনি সাধারণের মনে প্রোথিত করতে পেরেছিলেন। গালিলেয়ো আর আইনস্টাইনও তাঁদের গবেষণায় সেই চেষ্টাই চালিয়েছিলেন। বাচ্চা থেকে বুড়ো এই বইয়ের ভালবাসায় পড়েছিল। বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয়তম এই বই। শুনেছি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেসকে বাইবেলের পরে সব থেকে বেশি পয়সা এনে দিয়েছে এই বই।
আরও পড়ুন: পৃথিবীর শেষ স্টেশন পেরিয়ে গেলেন হকিং
ওঁর বইয়ের সম্পাদক সাইমন মিটন এক বার জানিয়েছিলেন, যখন বইটি করার সিদ্ধান্ত হয় তখন হকিংকে তিনি অনুরোধ করেছিলেন, যতটা সম্ভব ইকোয়েশন বাদ দিতে। তাঁর মনে হয়েছিল এ না হলে সাধারণের কাছে বইটি গ্রহণযোগ্য হবে না। শেষ পর্যন্ত একটি মাত্র ইকোয়েশন বইটিতে রাখা হয়েছিল। পদার্থবিদ্যা, গণিত নিয়ে গবেষণা করছেন, বয়স পঞ্চাশের কম— এমন অনেককেই প্রশ্ন করলে শুনি তাঁরা হকিংয়ের এই বই পড়েই পদার্থবিদ্যা, গণিত নিয়ে পড়াশোনা করবেন বলে ঠিক করেছেন।
বাচ্চাদের জন্য মেয়ে লুসির সঙ্গে হকিংয়ের লেখা বইগুলো বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতে ভীষণ ভাবে সাহায্য করেছে। প্রবল জনপ্রিয় গায়ক হকিংয়ের গলা নকল করে রক ব্যান্ড গান গাইছে এমন ঘটনাও ঘটেছে।
কেমব্রিজে ক্লাস করার সময় দেখেছি, হুইলচেয়ারে বসে রয়েছেন তিনি। শুধু একটি আঙুল নাড়াতে পারছেন। চোখ নড়ছে। কোনও এক ছাত্র তাঁর বক্তৃতার স্লাইডগুলো দেখাচ্ছে। ওঁর জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি যন্ত্রে হকিং হয়তো একটি বর্ণ টাইপ করলেন। এর পর ভয়েস প্রসেসর যন্ত্র তখন তাঁর বক্তব্য বলতে শুরু করল। ওই যন্ত্র থেকে যে কথা শোনা যেত, সেটি মার্কিন উচ্চারণে বলা। তাই বলার আগে জানিয়ে দেওয়া হত ওই স্বর হকিংয়ের নয়। শুনেছি ক্যালিফর্নিয়ার এক কোম্পানি ওই যন্ত্র বানিয়েছিল। হয়তো কোনও প্রশ্ন করলাম। উনি দীর্ঘ সময় ধরে টাইপ করতেন। তার পর ওই যন্ত্র থেকে উত্তরটা পাওয়া যেত। রসিক মানুষ ছিলেন হকিং। প্রশ্ন করার পরে ওঁর দিকে তাকালে কোনও কোনও সময় মনে হত ওঁর চোখ হাসছে। প্রবল কোনও রসিকতা করার ইচ্ছে ওঁর হচ্ছে। এর পর তো আঙুল নাড়ানোর ক্ষমতাও ওঁর চলে গিয়েছিল। ঠোঁট দিয়ে টিপে-টিপে তখন টাইপ করতেন। এই অবস্থাতেও ঘুরে বেড়াতেন গোটা দুনিয়া। বক্তৃতা দিতেন নানা দেশে। মনে আছে, ১৯৯৭ সালে আইইউকা-র এক সম্মেলনে পেনরোজ এসেছিলেন। অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি হকিং।
হকিং প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিলেন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন, মহাবিশ্বের সর্বত্র প্রাণ থাকা সম্ভব কি না সে নিয়ে প্রশ্ন, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কুফল নিয়ে প্রশ্ন। বার বার তিনি মানব সভ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন।
বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় বিজ্ঞানী অবশ্য নোবেল পুরস্কার পাননি। এ নিয়ে নোবেল কমিটির ব্যাখ্যা রয়েছে, ফলিত বিজ্ঞানের উপর যাঁরা কাজ করেন তাঁদের থেকেই নোবেল প্রাপক বাছা হয়। বিজ্ঞানের তত্ত্ব ঘাঁটা গবেষকদের জন্য নোবেল পুরস্কার নয়। যে কারণে হকিংকে নোবেল কমিটি কখনও এই পুরস্কারের যোগ্য বলে মনে করেনি। কিন্তু এতে নোবেলের গরিমাই বোধহয় ক্ষুণ্ণ হয়েছে। হকিং কিছু হারাননি।
অধিকর্তা, দি ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যস্ট্রোফিজিক্স (আইইউকা)