Science

বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা কেন নয়?

বাংলায় বিজ্ঞান লেখা যায় না বলে যাঁরা বলেন, তাঁদের বলি, অতীতে কিন্তু যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ও গ্রন্থ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হত।

Advertisement

সুশান্ত কুমার ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০৪
Share:

ছবি: সংগৃহীত

অতীব দুঃখের বিষয় যে বাংলা ভাষায় বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ও গ্রন্থ প্রকাশ ক্রমে উঠে যেতে বসেছে। অথচ এ আর কোনও বিতর্কের বিষয় নয় যে মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ না পেলে বিজ্ঞান চর্চা সর্বব্যাপী হতে পারে না। বাংলায় বিজ্ঞান লেখা যায় না বলে যাঁরা বলেন, তাঁদের বলি, অতীতে কিন্তু যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ও গ্রন্থ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হত। জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রাজশেখর বসু বহু বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করতেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহজ ভাষায় জনসাধারণের মাঝে বিজ্ঞানপরিচিতির জন্য কলম ধরেন। ‘বিশ্বপরিচয়’ নামে বই প্রকাশ করেন। এতে পরমাণুলোক, নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ ও ভূলোক নামে চারটি অধ্যায় ছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় অনুপ্রাণিত হয়ে একাধিক বিজ্ঞানসাধক ও অধ্যাপক অনেকগুলি সহজবোধ্য বৈজ্ঞানিক পুস্তিকা রচনা করেন— সেগুলি বিশ্বভারতীর ‘লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা’ ও ‘বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ’ নামক ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত পুস্তিকাগুলোর অন্তর্গত। কয়েকটির উল্লেখ করা যেতে পারে।

Advertisement

১) বিশ্বের উপাদান (বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ, প্রথম প্রকাশ কার্তিক ১৩৫০ বঙ্গাব্দ)। এই গ্রন্থে চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য ইলেকট্রন, প্রোটন, পজ়িট্রন ইত্যাদি মূল কণাগুলো সহজবোধ্য ভাষায় বর্ণনা করেছেন।

২) নব্যবিজ্ঞানে অনির্দেশ্যবাদ (বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ, প্রথম প্রকাশ ভাদ্র ১৩৫২)। প্রমথনাথ সেনগুপ্ত আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের অন্তর্গত ‘আনসার্টনটি প্রিন্সিপল’-এর মতো জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, যা ‘কোয়ান্টাম বলবিদ্যা’র গোড়ার কথা।

Advertisement

৩) গণিতের রাজ্য (বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ, প্রথম প্রকাশ পৌষ ১৩৫৭)। গগনবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায় গণিতের কয়েকটি প্রধান প্রধান বিষয় সম্বন্ধে অল্প আভাস দিয়েছেন। যেমন: ম্যাট্রিক্স বীজগণিত, জটিল সংখ্যা, ইত্যাদি।

৪) সম্ভাবনাতত্ত্ব (বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ, প্রথম প্রকাশ কার্তিক ১৩৮০ বাংলা)। প্রবাবিলিটি বা সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করেছেন অতীন্দ্রমোহন গুন।

৫) মৌল কণা (বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ, প্রথম প্রকাশ আশ্বিন ১৩৮০ বাংলা)। ইলেকট্রন, প্রোটন ইত্যাদি মৌল অর্থাৎ মূল কণাদের সম্বন্ধে বিভিন্ন দিক দিয়ে আলোচনা করেছেন দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়।

লোকশিক্ষা গ্রন্থমালার অন্তর্গত আরও কিছু বই: রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাণতত্ত্ব, প্রমথনাথ সেনগুপ্তের পৃথ্বীপরিচয়, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের ব্যাধির পরাজয় ও পদার্থবিদ্যার নবযুগ। বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহের গ্রন্থাদির মধ্যে: চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার (১৩৫০), রাজশেখর বসুর ভারতের খনিজ (১৩৫০), প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের হিন্দু রসায়নী বিদ্যা (১৩৫০), রুদ্রেন্দু কুমার পালের শরীরবৃত্ত (১৩৫০), প্রমথনাথ সেনগুপ্তের নক্ষত্র পরিচয় (১৩৫০), প্রিয়দারঞ্জন রায়ের বিজ্ঞান ও বিশ্বজগৎ (১৩৫০), দুঃখহরণ চক্রবর্তীর রঞ্জনদ্রব্য (১৩৫০), সর্বাণীসহায় গুহ সরকারের রসায়নের ব্যবহার (১৩৫১), জগন্নাথ গুপ্তের রমনের আবিষ্কার (১৩৫১) ও সতীশরঞ্জন খাস্তগীরের বেতার (১৩৫১)।

জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্লচন্দ্র রায় বাংলা ভাষায় অসংখ্য প্রবন্ধ বিভিন্ন মাসিক পত্রিকাতে লিখেছেন। জগদীশচন্দ্রের ‘আকাশ-স্পন্দন আকাশ-সম্ভব জগৎ’ প্রবন্ধটি সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকায় ১৩০২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে প্রথমে প্রকাশিত হয়। জগদীশচন্দ্রের অব্যক্ত প্রবন্ধ সঙ্কলনের ‘উদ্ভিদের জন্ম ও মৃত্যু’ রচনাটি ১৩০২ সালের ভাদ্র মাসে ‘মুকুল’ পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায় ‘গাছের কথা’ শিরোনামে প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল। জগদীশচন্দ্র বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে বাংলায় প্রচুর চিঠি লিখেছেন, তাদের অনেকগুলোই মূল্যবান বৈজ্ঞানিক তথ্যে সমৃদ্ধ। এ ছাড়া উল্লেখ্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ‘অধ্যাপক জগদীশচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার’ নামক সুদীর্ঘ প্রবন্ধটি, যা সাহিত্য পত্রিকার ১৩০৮ সালের ভাদ্র সংখ্যায় প্রথমে প্রকাশিত হয়।

প্রসঙ্গত এ কালের কয়েকটি বইয়ের কথাও বলি: শঙ্কর মুখোপাধ্যায় লিখিত শতবর্ষের ইতিহাসে কোয়ান্টাম মেকানিক্স, শঙ্কর সেনগুপ্ত লিখিত বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিদ্যা ও ব্যক্তিত্ব।

একাধিক ভাষা শেখা অবশ্যই আনন্দদায়ক এবং প্রয়োজনীয়। কিন্তু চাপে পড়ে একাধিক ভাষা শেখা অপ্রয়োজনীয় শক্তিক্ষয় মাত্র। বিশেষত, শিক্ষাজগতে বাংলা ভাষায় যদি যথেষ্টসংখ্যক বিজ্ঞানের বই রচিত হয় তবে ইংরেজি গ্রন্থের উপর নির্ভরতা অনেক কমবে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে বাংলা ভাষায় পড়া ও পড়ানো সহজ হবে। আমার এক শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ১৯৫০-এর দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, তিনি বলেছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁদের এক দিন বাংলা ভাষায় আপেক্ষিকতাবাদের মতো অত্যন্ত জটিল বিষয় সাবলীল ভাবে পড়িয়েছিলেন।

সুতরাং আমরা মনে করতেই পারি যে, উপযুক্ত বিজ্ঞানের বই রচিত হলে, এবং প্রচারিত হলে সর্ব স্তরে বাংলাতে বিজ্ঞান পাঠ সম্ভব হয়ে উঠতে পারে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement