সরকার পোষিত স্কুলগুলোয় পঠন-পাঠনের মানোন্নয়নের জন্য দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার স্কুলশিক্ষা দফতর একটা নতুন নির্দেশিকা জারি করেছে। শ্রেণিকক্ষে এ বার থেকে শিক্ষকের বসার জন্য কোনও চেয়ার রাখা যাবে না— নির্দেশিকার সারকথা মোটের উপরে এই।
কেন রাখা যাবে না চেয়ার? রাখা যাবে না, কারণ চেয়ার থাকলেই শিক্ষকের বসতে ইচ্ছা করবে এবং শিক্ষক এক জায়গায় বসে বসে পড়ালে শ্রেণিকক্ষের সব পড়ুয়ার কাছে তাঁর শিক্ষা সমান ভাবে পৌঁছবে না। শ্রেণিকক্ষের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ভ্রাম্যমান হয়ে যদি পড়ান শিক্ষক, তা হলে অনেক বেশি উপকৃত হবে পড়ুয়ারা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার স্কুলশিক্ষা দফতরের কর্তা অন্তত তেমনই মনে করছেন।
প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এই সিদ্ধান্ত বা এই নির্দেশিকাকে আক্রমণ করা যায় না। কারণ এই নির্দেশিকার পিছনে যে হেতুটা কাজ করছে, তাকে অমহতী বলা যাচ্ছে না বা স্কুলশিক্ষা দফতরের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাচ্ছে না। কিন্তু অন্যত্র প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে এবং একটা নয় একাধিক প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
প্রথম প্রশ্ন হল, শিক্ষক চেয়ারে বসার বদলে ভ্রাম্যমান অবস্থায় পড়ালে যে শিক্ষার্থীরা অনেক ভাল ভাবে শিখবেই, তা নিশ্চিত তো? এই তত্ত্ব কি কোনও সমীক্ষা থেকে উঠে এসেছে? কোনও সর্বমান্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কি এই তত্ত্ব প্রমাণ করে দেওয়া গিয়েছে?
দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, এই নির্দেশিকা জারি করার আগে কি শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন স্কুলশিক্ষা দফতরের কর্তা? নাকি অন্য অনেক নির্দেশের মতো উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এই নির্দেশও? স্কুলে স্কুলে নির্দেশিকা পৌঁছনোর পরে শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়া স্পষ্টই বুঝিয়ে দিচ্ছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের সম্পৃক্ত রাখা হয়নি। তার ফলে কী হতে পারে? তার ফলে, উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া অন্য যে কোনও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নীচের তলায় যেমন অসন্তোষ তৈরি হয়, এ ক্ষেত্রেও তেমনই হতে পারে। অসন্তোষের জেরে যেমন সিদ্ধান্তের রূপায়ণ পদে পদে বাধা পায়, এ ক্ষেত্রেও তেমনই বাধা পেতে পারে।
আরও পড়ুন: ক্লাসে চেয়ার বাদ, ক্ষুব্ধ শিক্ষকেরা
তৃতীয় প্রশ্নটা শিক্ষকরাই তুলছেন। তাঁরা উদ্বেগ নিয়ে জানাচ্ছেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেরই শারীরিক সক্ষমতা কমেছে, অনেকের নানা অসুস্থতা বা অক্ষমতা রয়েছে। একটানা দাঁড়িয়ে থাকা বা হাঁটাচলা করা তাই অত্যন্ত ক্লেশদায়ক হবে। শিক্ষকদের প্রশ্ন, একটানা দাঁড়িয়ে থাকার ফলে যে কষ্ট হবে, শিক্ষকরা তার মোকাবিলা করবেন, নাকি পড়ানোয় মন দেবেন?
শিক্ষক সংগঠনগুলো ইতিমধ্যেই খুব স্পষ্ট কণ্ঠস্বরে এবং জোরালো ভাষায় এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা শুরু করে দিয়েছে, তা নয়। শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। নানা স্তরের আলাপচারিতায় সে অসন্তোষ তাঁরা ব্যক্তও করছেন। কিন্তু পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা স্কুলশিক্ষা দফতরের কর্তাদের অতএব উচিত, পরিস্থিতি আর জটিল হয়ে উঠতে না দেওয়া। যে নির্দেশিকা জারি হয়েছে, তা কতটা রূপায়ণ যোগ্য, কী ভাবে রূপায়ণ যোগ্য— সে সব আবার নতুন করে খতিয়ে দেখা দরকার। প্রয়োজন হলে এই পুনর্বিবেচনার প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদেরও সম্পৃক্ত করে নেওয়া যেতে পারে কি না, তাও ভেবে দেখা উচিত।
উদ্দেশ্য যখন মহৎ, তখন সবকিছু ইতিবাচক পথে এগোক, এমনটাই কাম্য। কিন্তু কর্তৃপক্ষের আচরণটাও ইতিবাচক হওয়াই কাম্য।