সম্পাদকীয় ১

জাতীয় আতঙ্ক

বিদ্বেষের রাজনীতি এই ভারতে যে ভাবে উচ্চফলনশীল, তাহাতে নাগরিকত্বের মহিমা বেচিয়া এই মহান দেশে আজ বিস্তর ভোট মিলিতেই পারে। পশ্চিমবঙ্গও সেই দেশের বাহিরে নহে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:৩৪
Share:

জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) দ্রুত জাতীয় আতঙ্কের কারণ হইয়া উঠিতেছে। বিভিন্ন রাজ্যে এনআরসি চালু করিবার জন্য ভারতীয় জনতা পার্টির দাবি, সেই দাবিতে কংগ্রেস-সহ বিবিধ রাজনৈতিক শিবিরের প্রচ্ছন্ন বা প্রকট সমর্থন, একের প্রেরণায় অপর রাজ্যে অনুরূপ দাবি তুলিবার প্রস্তুতি— আগমার্কা নাগরিক বাছিতে বুঝি দেশ উজাড় হয়। অসমের তাণ্ডব শুরু হইবার অব্যবহিত পরেই মহামান্য দিলীপ ঘোষ ও সহশিল্পীবৃন্দ ‘পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি হইবে’ বলিয়া হুঙ্কার শুরু করিয়াছেন, ইহাতে আশ্চর্য হইবার কিছুমাত্র কারণ নাই। ২০২১ যত সমীপবর্তী হইবে, এই রাজনীতির কারবারিরা ততই সরব এবং সচল হইবেন। বিদ্বেষের বিষধর কালসর্প সহস্র ফণা মেলিয়াছে। এনআরসি একটি ফণা। কারবারিদের মতে, উহা একাই একশত। বিদ্বেষের রাজনীতি এই ভারতে যে ভাবে উচ্চফলনশীল, তাহাতে নাগরিকত্বের মহিমা বেচিয়া এই মহান দেশে আজ বিস্তর ভোট মিলিতেই পারে। পশ্চিমবঙ্গও সেই দেশের বাহিরে নহে।

Advertisement

তবে কিনা, বিষধর সর্প লইয়া খেলা কখনও কখনও আত্মঘাতী হইয়া উঠে। অসমে এনআরসি খেলিতে গিয়া বিজেপিও সমস্যায়। দ্বিমাত্রিক সমস্যা। এক দিকে নাগরিক পঞ্জির বহির্ভূতদের মধ্যে হিন্দুই বেশি। বিজেপি সেই সমস্যার মোকাবিলায় নাগরিকত্ব আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতিকে কাজে লাগাইতে চাহে— যে হিন্দুরা এনআরসির কোপে পড়িবেন তাঁহাদের প্রস্তাবিত আইন মারফত নাগরিকত্ব দেওয়া হইবে, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির দাবি মিটিবে। অন্য দিকে, মূলত ‘অসম অসমিয়াদের জন্য’ এই দাবিকে মূলধন করিয়া সেই রাজ্যে যে রাজনীতি আবর্তিত, তাহার নিকট ‘বহিরাগত’ মাত্রেই অবাঞ্ছিত, সে যে ধর্মেরই হউক। অসমের বিজেপি নেতারা এই জন্যই ক্ষুব্ধ হইয়া প্রকাশ্যে এনআরসি’র সমগ্র উদ্যোগটি নূতন করিয়া সম্পাদনের দাবি তুলিয়াছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও বুঝিতেছেন, তাঁহাদের সামগ্রিক অঙ্ক ও রাজ্যের স্বার্থের মধ্যে বিরোধটি একেবারে মৌলিক। অসমের এনআরসি অভিযান নিঃসন্দেহে বিশ বাঁও জলে।

কিন্তু তাহার পরেও তবে বিজেপির নেতারা এমন প্রবল বিক্রমে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে নাগরিক পঞ্জি প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি তথা হুমকি দিয়া চলিয়াছেন কেন? তাহার একটি কারণ— অসমের দ্বিমাত্রিক দ্বন্দ্ব অসমের নিজস্ব সমস্যা, ধর্মগত এবং জাতিগোষ্ঠীগত বিভাজনের এই জটিলতা অন্য রাজ্যে অন্তত এই আকারে এবং এতটা জটিলতায় নাই। কিন্তু অন্য সমস্যাগুলি তো আছে! বিশেষ করিয়া নাগরিকত্ব প্রমাণের দায় ব্যক্তির উপর চাপাইয়া দিলে মানুষ কতখানি আতঙ্কিত হইতে পারে তাহা এখন পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় প্রতিনিয়ত প্রকট হইয়া উঠিতেছে— এনআরসির কোপে পড়িবার দুশ্চিন্তায় আত্মঘাতী হইবার ঘটনা দৈনন্দিন সমাচারে পর্যবসিত। কিন্তু বিজেপি নেতারা এই সমস্যার মোকাবিলায় একটি সমাধানসূত্র প্রচার করিতেছেন: আগে নাগরিকত্ব আইন পাশ করাইয়া লওয়া হইবে, অতঃপর যে হিন্দুরা (এবং অন্য অ-মুসলমানরা) এনআরসির কোপে পড়িবেন তাঁহাদের ওই আইনের জোরে নাগরিক করিয়া লওয়া হইবে, সুতরাং তাঁহাদের কোনও ভয়ের কারণ নাই। অর্থাৎ, সমগ্র উদ্যোগের লক্ষ্য একটিই: ‘অনুপ্রবেশকারী’ মুসলমানদের বিতাড়ন। এতটাই খোলাখুলি এই ধর্মভিত্তিক বিভাজনের কথা বলা হইতেছে, যাহা অনিবার্য ভাবে দেশভাগের উদ্যোগপর্বের কথা মনে পড়াইয়া দেয়। এই নিরাবরণ রাজনীতিই যদি সংখ্যাগুরু নাগরিকের মন জয় করিতে পারে, তবে বুঝিতে হইবে, ভারত সত্যই বদলাইয়াছে। সেই হিসাবে, এনআরসি ও নাগরিকত্ব আইনের রাজনীতিই এখন ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক ভারতের অগ্নিপরীক্ষা। হয়তো বা শেষ পরীক্ষাও।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement