রবিবার, ২৪ জুন মধ্যরাতে রিয়াধের রাস্তায় ইতিহাস সৃষ্টি হল। কয়েক দশকের নিষেধের বাধা অতিক্রম করে ছুটে গেল গাড়ি, যার স্টিয়ারিং এক মহিলার হাতে। পৃথিবীতে একমাত্র সৌদি আরবেই মেয়েদের গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ ছিল। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে দেশের কর্ণধার রাজা সলমন ঘোষণা করেন, এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে। গত ২৫ জুন থেকে সেই পরিবর্তন কার্যকর হল। এই মুক্তির স্মরণীয় ক্ষণটির জন্য শুধু সৌদি মহিলারা নন, অপেক্ষা করছিল সারা পৃথিবী।
তবু এই অপেক্ষা-শেষের আলো মধ্যরাতের সব অন্ধকার ঢেকে দিতে পারল না। কারণ ঠিক তখনই লোকচক্ষুর আড়ালে জীবন কাটাচ্ছিলেন গ্রেফতার হওয়া বেশ কয়েক জন সৌদি নারী এবং পুরুষ, যাঁদের কেউ মানবাধিকার কর্মী, কেউ বা লড়াই চালাচ্ছিলেন নারীর অধিকারের দাবিতে। তাঁদের সংখ্যা ঠিক কত, তাঁরা কোথায় আছেন, কী ভাবে আছেন, কেউ জানেন না। সারা বিশ্বের মানবাধিকার কর্মীরা তাঁদের জন্য দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ সংস্থা বলছে, “নারীর অধিকার অর্জনের সংগ্রামের উপর এ এক নির্দয়, কঠোর আক্রমণ।”
লাউজইন আল-হাথলাউল সৌদি আরবের সুপরিচিত নারীবাদী, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর দৃপ্ত বিচরণ। মেয়েদের ড্রাইভিংয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা বাতিল করার দাবিতে তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে লড়াই চালাচ্ছেন। ২০১৫ সালে মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে তিনি একশো জন শক্তিশালী আরব নারীর তালিকায় তিন নম্বরে চলে আসেন।
লাউজইন আল-হাথলাউল
তার আগের বছর একাই গাড়ি চালিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে সীমান্ত পেরিয়ে সৌদি আরবে ঢোকার চেষ্টা করেন এবং গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি। তিয়াত্তর দিন দীর্ঘ ছিল সেই বন্দি জীবন। ২০১৭ সালে আবার গ্রেফতার হন এই সাহসিনী। নারীর উপর পুরুষের ‘অভিভাবকত্ব’-এর বিরুদ্ধে চোদ্দো হাজার সই সংগ্রহ করেছিলেন আগের বছর, কিন্তু তাঁকে গ্রেফতারের সঠিক কারণ দেখানো হয়নি। বাড়ির লোক বা আইনজীবী কারও সঙ্গে তাঁকে যোগাযোগই করতে দেওয়া হয়নি। আর এই বছর, যখন বহুকাঙ্ক্ষিত সেই ড্রাইভিং লাইসেন্স তাঁদের হাতে ওঠার কথা, তখনই মে মাসে ইমান আল-নাফজান, আইশা আল-মানা, আজ়িজ়া আল-ইউসেফ, মাদেহা আল-আজরাউস প্রমুখ বেশ কয়েক জন নারীবাদী কর্মী এবং পুরুষ মানবাধিকার কর্মীর সঙ্গে হাথলাউলকে ফের গ্রেফতার হতে হয়েছে। সকলেই যথারীতি নিখোঁজ।
নাফজান সৌদি আরবের পরিচিত নারী অধিকার কর্মী, অধ্যাপিকা এবং লেখিকা। ইউসেফ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। কিন্তু এই সব পরিচয় তাঁদের রক্ষা করতে পারেনি। এই জুনেই কমপক্ষে এমন দশ-পনেরো জন মহিলা কর্মী গ্রেফতার হয়েছেন যাঁরা পুরুষের ‘অভিভাবকত্ব’-এর বিরুদ্ধে, গাড়ি চালানোর অধিকারের দাবিতে দীর্ঘ দিন লড়াই করে আসছেন। এঁদের মধ্যে আছেন নউফ আবদেলাজ়িজ়, মায়া আল-জ়াহারনি প্রমুখ। সেপ্টেম্বর থেকেই নাকি সৌদি মানবাধিকার কর্মীদের ভয় দেখানো হচ্ছে, যাতে তাঁরা মেয়েদের এই গাড়ি চালানোর বিষয়ে কোনও রকম মন্তব্য না করেন।
সৌদি আরবে মেয়েদের, পুরুষের অনুমতি সাপেক্ষে, মোটর বাইক ও ট্রাক চালাবার পালাও শুরু হচ্ছে। এমনকি সিনেমা হল, খেলার স্টেডিয়ামেও সৌদি মেয়েরা প্রবেশাধিকার পাবেন। এই সব সিদ্ধান্তের অধিকাংশই নেওয়া হয়েছে গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে। ‘আধুনিক’ সৌদি আরবের ‘মুক্ত নারী’র যে বিশ্ববন্দিত ধারণা, তার ভগীরথ হিসাবে আমরা জেনেছি রাজপুত্র মোহাম্মদ বিন সলমনের নাম। তিনি বলেছেন, “সৌদি নারীরা আজও তাঁদের প্রাপ্য অধিকার পাননি। তবে আমরা অনেকটা পথ এসে গিয়েছি, আর সামান্য পথ বাকি।”
সত্যিই কি আর সামান্য পথ হাঁটলেই সৌদি নারীর মানবাধিকার সম্পূর্ণ রূপে স্বীকৃত হবে? তা হলে ২০১৫ সাল থেকে নারীবাদী ও মানবাধিকার কর্মীদের এই হারে গ্রেফতার, মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা চলছে কেন? রাজপুত্রই বা এ বিষয়ে নীরব কেন? তাঁর ‘নারীমুক্তি’র স্লোগান কি কেবল নিজেকে নায়ক বানানোর জন্যই? অবশ্য নিন্দুকরা তো এই ‘উদারতা’র নেপথ্যে পশ্চিম দুনিয়াকে খুশি করে তেলের বাজারে মন্দা এবং ব্যবসাবাণিজ্য সামলানোর কৌশলও খুঁজে পান।
নারীর অধিকার অর্জনের লড়াই করতে গিয়ে আজ সৌদি আরবে যাঁরা বন্দি, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি অদ্ভুত। হাথলাউলদের গ্রেফতার করে সে দেশের এক মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, “যাঁরা বন্দি, তাঁদের ‘বিদেশি সংযোগ’ বিষয়ে অনুসন্ধান করা হচ্ছে।” ইউসেফ গ্রেফতার হওয়ার পরের দিন কাগজে লেখা হয়েছিল, “আপনার বিশ্বাসঘাতকতা ব্যর্থ হয়েছে।” এই বন্দিনিরা দেশের “নিরাপত্তা ও শান্তির পথে প্রতিবন্ধক”, এমনটাই অভিযোগ।
‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ এই বন্দিদের কারাজীবনের যন্ত্রণা এবং তাঁদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা নিয়ে নথি প্রকাশ করেছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে এই বন্দিদের কথা তুলে ধরেছেন নারীবাদী কর্মী ও ব্লগার নোরা আবদুলকরিম। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সম্পর্কিত শাখার মুখপাত্র লিজ় থ্রোসেল বলেছেন, “ছ’জন মহিলা ও তিন জন পুরুষ বন্দি আছেন। এঁদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হয়েছে, যে কঠোর সাজা হতে পারে।” রাজার বা ধর্মগুরুর রক্তচক্ষু দেখেও ভয় না পেয়ে গাড়ি চালানো-সহ নানা বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেলেন যাঁরা, সৌদি নারীর ইতিহাসের এই মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁরাই কারান্তরালে!
এই মিথ্যেও মানা যাবে না যে, এক রাজপুত্র এসে হ্যামলিনের বাঁশির ম্যাজিকে সৌদি নারীকে স্টিয়ারিংয়ের পিছনে বসিয়ে দিলেন। এর জন্য অনেক কান্না ঘাম ঝরেছে। ১৯৯০ সালে সাতচল্লিশ জন সৌদি মহিলা প্রথম সংগঠিত ভাবে পথে নেমেছিলেন ড্রাইভিং-সহ বিভিন্ন বিষয়ে মেয়েদের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার দাবি নিয়ে। ২০০৭ সালে ওয়াজ়েহা আল-হুয়াইদার নাম্নী এক নারীবাদী ও লেখিকা প্রতিষ্ঠা করেন ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রোটেকশন অ্যান্ড ডিফেন্স অব উইমেন’স রাইটস ইন সৌদি অ্যারাবিয়া’। ২০০৮ সাল থেকেই তিনি মেয়েদের গাড়ি চালানোর অধিকারের দাবিতে সামিল ছিলেন। ২০০৯ সালে পুরুষ সঙ্গী ছাড়া হুয়াইদার বাহরিনের সীমান্ত পেরোনোর চেষ্টা করেন। সমর বাদওয়াই নিজের বাবার বিরুদ্ধে ‘নির্যাতন’-এর অভিযোগ এনে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে সারা দেশে হইচই ফেলে দেন। আইনের জগতে মেয়েদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। ২০১৩ সালে তিনি ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ’ পুরস্কার পান। হাইফা আল-মনসুর পরিচালনা করেন ‘ওয়াজ়দা’ নামের একটি ছবি, যেখানে এক কিশোরী একটি বাইক পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। তার আর তার মায়ের যন্ত্রণা ও লড়াই সমগ্র সৌদি নারী সমাজকে প্রতিফলিত করেছিল এই ছবিতে। লড়াইটা রূপকথার রাজপুত্তুরের— এত সহজ গল্প কোনও দিন ছিল না; এখনও নেই।
সৌদি আরবের রাজতন্ত্রে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও লেগে নেই। ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স’-এ এ দেশের স্থান ১৩৫-এর মধ্যে ১৩১। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম ২০১৩ সালেও মেয়েদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সৌদি আরবকে শূন্য দিয়েছিল। আজও সৌদি নারী নিজের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন না। ‘অভিভাবকত্ব’ প্রথা এখনও বহাল, অর্থাৎ পুরুষের অনুমতি ছাড়া নারী তাঁর জীবনের কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। সে পুরুষ তাঁর চার বছরের ভাইও হতে পারে। পাসপোর্ট করতে হলে পুরুষের সম্মতি নিতে হয়। সৌদি মেয়ের বিবাহ বা বিবাহবিচ্ছেদে অনুমতি দেওয়ার মালিকও সেই পুরুষ। নিজের ইচ্ছায় পোশাক পরার কথা ভাবাই যায় না। ক্যাফেটেরিয়াতে চা কফি খেতে চাইলেও মহিলাদের পুরুষ আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। নারী প্রাত্যহিক জীবনের ঝড়ঝাপ্টার মধ্যে নিজেকে যাচাই করার স্বাধীনতা বা সুযোগ কোনওটাই পান না— একলা বাইরে যাওয়া, একলা দোকানপাট করা, সর্বত্রই নিষেধ।
গাড়ি চালানো, খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে যাওয়া ইত্যাদির মধ্যে বদ্ধকূপ থেকে মুক্তির স্বাদ নিশ্চয় আছে। কিন্তু তা দিয়ে কি নারীসমাজের বুকে আত্মসম্মান বা আত্মনির্ভরতার আশ্বাস এনে দেওয়া যায়? রাজপুত্র কি সত্যিই তাঁর রাজত্বের অর্ধেক আকাশে মুক্ত বিহঙ্গ উড়তে দেখতে চান? চাইলে মানবাধিকার কর্মীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ে সামিল না হয়ে, তাঁদের বন্দি হতে দেখেও তিনি হাত গুটিয়ে বসে আছেন কেন?
রক্ষকের ‘উদারতা’ নয়, জান-কবুল লড়াইই এক দিন সৌদি নারীকে স্বাধীনতা এনে দেবে। ইতিহাস আমাদের এমনটাই ভাবতে শিখিয়েছে।