আখড়া: সত্যজিৎ রায়ের গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবির একটি মুহূর্ত
বছরশেষের দিনগুলোতে বাঙালির হৃৎকমলে বড় ধুম লেগেছে। রাজনীতির হাটে নিত্যনব অলীক কুনাট্য রঙ্গ, মিডিয়ার বালুকাবেলায় তার ঢেউ আছড়ে পড়ছে অবিরত। আর রঙ্গের টানে ব্যঙ্গ আসবেই। সমাজমাধ্যমের ভুবন জুড়ে এখন ব্যঙ্গবিদ্রুপের প্লাবন। গদ্যে, পদ্যে, ছবিতে মুহুর্মুহু ক্ষেপণাস্ত্র ছুটছে ক্ষমতার বড় মেজো সেজো ছোট কারবারি এবং তাঁদের চেলাচামুণ্ডাদের নিশানা করে। ব্যঙ্গের বিস্তর রসদ তাঁরা সরবরাহ করছেন, রসিক বাঙালি পরম উৎসাহে সে-সব ব্যবহার করছে।
সদ্ব্যবহার কি না, সেটা অবশ্য তর্কের বিষয়। বঙ্গীয় রসিকতা এই মরসুমে উচ্চফলনশীল, কিন্তু ফলন ভাল হলেই ফসল স্বাদে গন্ধে উৎকৃষ্ট হবে, পুষ্টিকর হবে, তা নয়— ভালবেসে কিনে আনা আপেলটি দেখতে একেবারের আপেলের মতো টুকটুকে, খেতে গেলে ঘাসের অধম, এ-রকম তো কতই হচ্ছে। রাজনৈতিক ব্যঙ্গের ইতিহাস প্রাচীন, সমৃদ্ধ। দুনিয়ার কথা ছেড়ে দিলাম, বাংলা ভাষার ভান্ডারেই জমা আছে তার বিবিধ রতন। সেই মাপকাঠিতে দেখলে এ-কালের ফসল নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়া কঠিন।
সেটা অস্বাভাবিক নয়। জমি যেমন, ফসল তেমনই হয়ে থাকে। আমাদের সমাজে, বিশেষত সমাজমাধ্যমে, রাজনীতির আলোচনা বলতে ইদানীং যে জিনিস প্রচলিত হয়েছে, তার বেশির ভাগটাই রবীন্দ্রনাথের কালান্তর প্রবন্ধের সূচনায় বলা ‘চণ্ডীমণ্ডপের আখড়া’র কথা মনে পড়িয়ে দেয়। পারস্পরিক কুৎসা বা গালিগালাজের প্রসঙ্গে যাওয়ার দরকার নেই, সেই আবর্জনা সব যুগেই থাকে, কম বা বেশি। রবীন্দ্রনাথও সে-পাঁক ঘাঁটতে যাননি, তাঁর সমালোচনার লক্ষ্য ছিল সমাজের সীমাবদ্ধ মনের ক্ষুদ্রতা: ‘‘যে জগতের মধ্যে বাস সেটা সংকীর্ণ এবং অতি-পরিচিত। তার সমস্ত তথ্য এবং রসধারা বংশানুক্রমে বৎসরে বৎসরে বার বার হয়েছে আবর্তিত অপরিবর্তিত চক্রপথে, সেইগুলিকে অবলম্বন করে আমাদের জীবন-যাত্রার সংস্কার নিবিড় হয়ে জমে উঠেছে, সেই সকল কঠিন সংস্কারের ইঁটপাথর দিয়ে আমাদের বিশেষ সংসারের নির্মাণকার্য সমাধা হয়ে গিয়েছিল।’’
সেই প্রাক্-উপনিবেশ যুগ থেকে এই ভুবনগ্রামের কাল নিশ্চয়ই বহু দূরে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজ তো গত কয়েক দশক ধরে একমনে নিজেকে চণ্ডীমণ্ডপে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাধনাতেই ব্রতী। সাধনা বহুলাংশে সফল হয়েছে, আমরা জগৎ ও জীবনকে বিঘৎপরিমাণে দেখতে এবং দেখাতে পারদর্শী হয়েছি। আমাদের রাজনীতি অনেক দিন যাবৎ সেই ক্ষুদ্রতা ও তুচ্ছতার আখড়ায় পরিণত, রাজনীতির আলোচনা তার গণ্ডিতেই চক্রপথে আবর্তিত হয়ে চলে, সেই চাক থেকেই উঠে আসে আমাদের রঙ্গরসিকতা। রাজনীতি এবং রাজনীতিক নিয়ে আমরা হরেক রকমের তামাশা করি, হুল ফোটাই, পয়ার-ত্রিপদীতে চমৎকার চালাকি ছুড়ে দিই, কিন্তু যে গভীর বোধ এবং তীক্ষ্ণ সমালোচনা কৌতুক বা ব্যঙ্গকে যথার্থ রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করতে পারে, এই ফেনার সাগর ছেঁচে তার সন্ধান সচরাচর মেলে না। ক্রমাগত ভেসে আসা নানান রসিকতা পড়ি, দেখি, শুনি, হাসি, শেয়ার করি, এবং পরবর্তী রসিকতার দিকে এগিয়ে যাই।
সেটা দুঃখের হলেও এমনিতে তাতে ভয়ের কিছু ছিল না। একটা অগভীর রাজনীতির সংস্কৃতিতে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে নানান কৌতুক-নকশার স্বাদ নেওয়া— মন্দ কী? আর, কেউ মুখ বেঁকালে বলাই যেত: যদি ভাল না লাগে তো দিয়ো না মন। কিন্তু আজ আর সে-কথা বলে পাশ ফিরে শোয়ার কোনও উপায় নেই। কেন, সেটা বছর দেড়েক আগে খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন এচে তেমেলকুরান। তুরস্কের এই লেখক-সাংবাদিকের লেখা একটি বই গত বছরের গোড়ার দিকে প্রকাশিত হয়। বইটির নাম: হাউ টু লুজ় আ কান্ট্রি। তুরস্কে প্রায় দু’দশক শাসন করছেন রেচেপ তাইপ এর্দোয়ান। এই শতকের গোড়ায় নতুন দল গড়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে গদিতে বসেছিলেন, ক্রমে ক্রমে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছেন, বিচারবিভাগ থেকে শুরু করে নির্বাচন নামক অনুষ্ঠানটিও সেই আধিপত্যের বাইরে নেই আর। নির্বাচনী গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরাচারের যে-সব প্রতিমা নানা দেশে বিরাজমান, প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান তাদের প্রথম সারিতে। তেমেলকুরান অনেক দিন অবধি তুরস্কে থেকে এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লিখেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, উত্তরোত্তর রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরাগভাজন হয়েছেন, এবং এক সময় দেশের মেয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। শুধু তুরস্ক নয়, নানা দেশের সাম্প্রতিক ইতিবৃত্ত বিচার করে তিনি খুঁজে পেয়েছেন কয়েকটি সাধারণ প্রবণতা, যার মধ্যে দিয়ে তারা গণতন্ত্র থেকে একনায়কতন্ত্রের পথ ধরে চলেছে অথবা ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে স্বৈরশাসনের নিবিড় ঘন আঁধারে। এই নিয়েই লেখা তাঁর বই, যেখানে বিশদ ভাবে বোঝানো হয়েছে— কী করে একটা দেশ তার গণতন্ত্রকে হারিয়ে ফেলে।
বইটি প্রথম বার পড়ার পর থেকে বারে বারে তার কাছে ফিরে গেছি, পিছল পথের বিবরণ মিলিয়ে নিতে চেয়েছি স্বদেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে। এবং নানা ব্যাপারে আশ্চর্য সব মিল খুঁজে পেয়ে ভয়ের মাত্রা ক্রমশই বেড়েছে। যেমন নতুন করে ভয় পাইয়ে দিল একটি অধ্যায়: ‘লেট দেম লাফ অ্যাট দ্য হরর’— দুঃশাসনের ভয়ানক মূর্তিকে যারা হেসে উড়িয়ে দিতে চাইছে তাদের হাসতে দাও। তেমেলকুরান লক্ষ করেছেন, অনেক দিন পর্যন্ত এর্দোয়ান ও তাঁর শাগরেদদের নানা উৎকট আচরণ দেখে অনেকেই হেসেছে, রসিকতা করেছে, বলেছে— ওদের এত পাত্তা দেওয়ার মানে হয় না, দেশের মানুষ ওদের ঠিক ঠিক চিনে নেবে এবং কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করবে। ঘটেছে তার উল্টো। হাসিঠাট্টা, রঙ্গব্যঙ্গ, সব বেবাক হজম করে নিয়েছেন ওঁরা, উত্তরোত্তর চেপে বসেছেন ক্ষমতায়, ব্যঙ্গবিদ্রুপের স্রষ্টারা যখন সেটা টের পেয়েছেন তত দিনে আর কিছু করার নেই। এই অভিজ্ঞতা ছিল বলেই ২০১৭’র গোড়ার দিকে আমেরিকায় এক অনুষ্ঠানে নয়া প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে ঠাট্টাতামাশায় মশগুল মেয়েদের উদ্দেশে তরুণী তুর্কি বলেছিলেন, ‘‘হাসছেন বটে, কিন্তু সাবধান— কেন হাসছেন এবং কেমন হাসি হাসছেন, সেটার দিকে খেয়াল রাখবেন।’’
কেন হাসছি, কেমন হাসি হাসছি, নিজের কাছে, নিজেদের কাছে সেই হাসির কী মানে তৈরি করছি, এই প্রশ্নগুলো ভাবিয়ে তোলে। ক্ষমতাবানদের ব্যঙ্গ করে, বিদ্রুপে বিদ্ধ করে আমরা অনেক সময়েই মনে মনে প্রতিবাদের স্বাদ মেটাই। সমাজমাধ্যমের কল্যাণে ইদানীং এই মানসিকতা আরও জোরদার হয়েছে— ক্ষমতাবানের প্রতি কেউ একটি ব্যঙ্গ বা বিদূষণ ছুড়ে দিলেই যদি মুহূর্তের মধ্যে সেটি লক্ষ জনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তা হলে সেই জনগণমনে এক ধরনের প্রতিবাদী সংহতির বোধ তৈরি হওয়া অসঙ্গত নয়। সেই বোধ সহজেই আত্মতৃপ্তিতে পরিণত হতে পারে। সে-পরিণতি শুধু দুর্ভাগ্যজনক নয়, বিপজ্জনকও বটে, কারণ তা প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির শক্তি হরণ করে। ব্যঙ্গ তখন রাজনীতির প্রকরণ না হয়ে রাজনীতির বিকল্প হয়ে ওঠে। এবং তার ফলে এক অমোঘ দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় সেই ব্যঙ্গ ক্রমশ তার রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়ে ফেলে, হয়ে ওঠে রাজনীতির মোড়কে গণ-বিনোদনের পণ্য।
ফেসবুক-আদি সমাজমাধ্যমের বাণিজ্য-কৌশল এই গণ-প্রিয়তাকে একটা অ-পূর্ব গুরুত্ব এবং প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। সেই বাণিজ্যের ভুবনে পরিচিত ‘মেটকাফ সূত্র’ অনুসারে, একটি যোগাযোগ-মাধ্যম যত জন ব্যবহার করছেন সে-সংখ্যা দ্বিগুণ হলে ওই মাধ্যমের ব্যবসায়িক দর চারগুণ বেড়ে যায়, সংখ্যাটি পাঁচগুণ হলে দর বাড়ে পঁচিশগুণ। এই সূত্র ধরে আমেরিকার বামপন্থী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোডি ডিন তাঁর ‘কমিউনিকেটিভ ক্যাপিটালিজ়ম’-এর ধারণাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, এই ব্যবসার চালকদের কাছে আমার-আপনার কোনও মেসেজ-এর নিজস্ব কোনও মূল্য নেই, বার্তাটি কত লোক দেখলেন, কত জন তাতে লাইক দিলেন, কত জন শেয়ার করলেন, সেগুলোই মূল্যবান। পুরনো গণমাধ্যমেও এই হিসেব ক্রমশই আধিপত্য বিস্তার করেছে— টেলিভিশন চ্যানেলের টিআরপি রেটিংয়ের মাহাত্ম্য সর্বজনবিদিত। কিন্তু সমাজমাধ্যমের চরিত্র ও বিস্তার সেই আধিপত্যকে পৌঁছে দিয়েছে এক সম্পূর্ণ নতুন মাত্রায়। আর তার অনিবার্য প্রভাব পড়েছে আমাদের চেতনায়। আমরা সেই ভাবেই ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছি, যা তৎক্ষণাৎ বহু জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। তার শ্রেষ্ঠ উপায় এমন কিছু বলা বা করা যাতে অনেককে চমক দেওয়া যায়। আমরা এখন মানুষকে ভাবিয়ে তুলতে চাই না, চমক দিতে চাই। আমাদের রাজনৈতিক ব্যঙ্গও সেই ধারায় গা ভাসিয়েছে।
সে-কারণেই এচে তেমেলকুরানের সাবধানবাণী আমাদের পক্ষে বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। রঙ্গরসিকতা, ব্যঙ্গবিদ্রুপ, তামাশা, সবই চলবে, চলুক। শতপুষ্প ও সহস্র আগাছা বিকশিত হোক। কিন্তু আমরা এখন যে বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যথার্থ রাজনীতিই তার মোকাবিলার একমাত্র উপায়। সে রাজনীতি পরিশ্রমের, সংগঠনের, সমন্বয়ের। সেই সত্যমূল্য না দিয়ে যদি নিজেদের ব্যঙ্গ ও বিদূষণের মৌতাতে বিভোর হয়ে ‘কেমন দিলাম’ ভেবে আত্মপ্রসাদ অনুভব করি, তা হলে অচিরেই আমরাও চণ্ডীমণ্ডপে বসে পরম আমোদে পরস্পরকে বলতে পারব— কী করে একটা রাজ্যকে হারিয়ে ফেলতে হয়।